রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বাসগুলো আইন শৃংখলা বাহিনী, মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি, স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে চলাচল করছে। অথচ ঢাকা নগর পরিবহনে কেউ চাঁদাবাজি করার সাহস দেখায় না।
স্টাফ রিপোর্টার
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রুটে এখন দুই ধরণের বাস চলাচল করছে। সবগুলো রুটে চলাচল করে বাস মালিক সমিতির সদস্যদের ব্যাক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন। মাত্র একটি রুটে চলাচল করছে দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের উদ্যোগে বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা নগর পরিবহণ। আরো তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন চলাচলের ঘোষণা দিলেও এখন কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের রুটে চলছে ৫০টি বাস। এই দুই ধরণের বাসের ভাড়া, যাত্রী সেবা এবং বাস পরিচালনায় শৃংখলায় রয়েছে বিস্তর ফরাক। যাত্রীদের মতে ঢাকা নগর পরিবহণের বাস সবগুলো রুটে দেয়া হলে রাজধানীতে যানজট কমবে। চাঁদাবাজি থাকবে না, যত্রতত্র যাত্রী নিতে এবং নামাতে বাস থাকবে না এবং যাত্রী ধরার প্রতিযোগিতা হবে না। ঢাকা নগর পরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে যে ভাড়া আদায় করা হয় ব্যাক্তিমালিকানাধীন বাসগুলোতে তার দ্বিগুন কোনো কোনো বাসে তিনগুণ বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন রুটের বাসে ড্রাইভার ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ঢাকা নগর পরিবহণ নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করতে পারে; কারণ কোথাও চাঁদা দিতে হয় না। অথচ বিভিন্ন রুটে চলাচল করা ব্যাক্তি মালিকানাধীন বাসগুলোতে বিভিন্ন পয়েন্টে আইন শৃংখলা বাহিনী, শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন, স্থানীয় এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি বাসকে প্রতিদিন ৩শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। ফলে বাসগুলো সরকারি নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করতে বাধ্য হয়। বিআরটিএ ও বিআরটিসি উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীতে চলাচল করা বিভিন্ন রুটের বাসগুলোকে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ এর আওতায় আনতে পারলে চাঁদাবাজি বন্ধ হতো; তখন যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুনতে হতো না। পরিবহনে সেক্টরে চাঁদাবাজি, অনিয়ম বন্ধের মহৌষধ হতে পারে ঢাকা নগর পরিবহণ।
শনির আখড়া থেকে ঢাকা নগর পরিবহনের মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। এ বাস স্টপেজ ছাড়া কোথাও থামে না। অথচ একই দূরত্বে হিমালয় বাস ভাড়া নেয় ২০ টাকা। শুধু তাই নয় যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা হয়। অন্যান্য বাসের একই চিত্র।
শনির আখড়া থেকে পল্টন মোড় ঢাকা নগর পরিবহণে ভাড়া নেয়া হয় ১২ টাকা। অথচ এ দূরত্বে অন্যান্য বাস ভাড়া আদায় করে ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। ফলে যাত্রীদের কাছে ঢাকা নগর পরিবহণ ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু বাস মালিক সিণ্ডিকেট নানাভাবে ঢাকা নগর পরিবহন যাতে টিকতে না পারে সে লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করছে। ঢাকা নগর পরিবহনের একজন ড্রাইভার জানান, তাদের বাসগুলো যাতে দ্রুত যাতায়াত করতে না পারে সে জন্য নানাভাবে সড়কে প্রতিবন্ধকতা করে রাখে অন্যান্য রুটের ব্যাক্তিমালিকানাধীন বাসগুলো।
মূলত রাজধানীর গণপরিবহনে বিশৃংখলা দূর করতে বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু হয় ঢাকা নগর পরিবহনের। শুরুতে অনেক সংকট থাকলেও কাউন্টার ছাড়া যাত্রী ওঠানামা না করা এবং টিকিট ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট ভাড়া আদায়ে প্রথম মাসেই আস্থার জায়গা অর্জন করে সিটি করপোরেশন পরিচালিত এই বাস কোম্পানি। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই বাসগুলোকে তুলে দিতে ফন্দিফিকির শুরু হয়ে গেছে। পরিবহণ মালিকদের ইন্দনে শ্রমিকরা নানাভাবে ঢাকা গণপরিবহণ চলাচলে বাঁধাবিপত্তির সৃষ্টি করছে।
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের রুটে মাত্র ৫০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে নগর পরিবহন। প্রতিশ্রুতি ছিল, শিগগিরই বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে। কিন্তু বাসের সংখ্যা না বাড়িয়েই এই রুটে চলাচলকারী রজনীগন্ধ্যা পরিবহনের দুই/আড়াইশ বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে গণপরিবহনের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে কয়েক লাখ অফিস যাত্রীর এই রুটে। নগর পরিবহনের যাত্রী ও কাউন্টারম্যানরা বলছেন, নগর পরিবহনের মাত্র ৫০টি বাস একদমই অপ্রতুল এই বিশাল রুটের জন্য। আগে বাসগুলো যাত্রী তুলেও আরও যাত্রীর জন্য মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এতে যাত্রীদের অনেক সময় পথেই নষ্ট হতো। আর বর্তমানে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস কাউন্টারেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সময়ভেদে এই অপেক্ষা ১০ থেকে ১৫ মিনিট থেকে শুরু করে এক থেকে দেড় ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। তবে এখানেই মুক্তি নেই। অনেক সময় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যাত্রীরা বাসে উঠতে পারছেন না। সকাল ও বিকেলে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে নগর পরিবহন। দাঁড়ানোর মতো সুযোগও থাকে না। নিয়মিতই কাউন্টারম্যানদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন যাত্রীরা।
বছিলা র্যাব অফিসের সামনে অবস্থিত নগর পরিবহনের কাউন্টারম্যান বলেন, সকালের প্রথম বাস আসে সাড়ে ৭টায়। এর আগেই কাউন্টারের সামনে জমে যায় অর্ধশত যাত্রী। বিকল্প উপায় না থাকায় যাত্রীদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো এক থেকে দেড় ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। তবে যাত্রীদের অপেক্ষায় রাখতে আমাদেরও ভালো লাগে না। কিন্তু কিছুই করার নেই। দ্রুত বাসের সংখ্যা না বাড়ালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই সার্ভিস ক্ষতির মুখে পড়বে।
নগর পরিবহনের নিয়মিত যাত্রীরা বলছেন, শুরুতে নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যাত্রী ওঠানামা বন্ধ রাখার বিষয়টি ছিল সাধুবাদ পাওয়ার মতো। মাস দুয়েকের ব্যবধানে ভেঙে পড়েছে সেই শৃংখলাও। এখন কাউন্টারের বাইরেও অনেক জায়গাতেই যাত্রী নামানো হয়। আর বিশেষ বিশেষ সময়ে সুযোগ পেলে যাত্রীও ওঠান বাসের চালক-হেলপাররা। সবে দুই মেয়রের এই উদ্যোগে যদি বিআরটিসি সহায়তা করতো তাহলে মানুষ উপক্রত হতো।
এদিকে, বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কর্তৃপক্ষ একের পর এক মিটিং করলেও বাসের সংখ্যা বাড়ানোর কোনো সুখবর পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৭ ফেব্রুয়ারি সবশেষ অনুষ্ঠিত হয় একবিংশতিতম সভা, যাতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ওই মিটিং শেষে শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, শংকর, শাহবাগ হয়ে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে এই একক কোম্পানির বাস চলছে। যেখানে নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে বাসে উঠছেন যাত্রীরা। এখন ঘাটারচর থেকে আসাদগেট দিয়ে ফার্মগেট, পল্টন হয়ে ভুলতা পর্যন্ত নগর পরিবহনের বাস নামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়াও ঘাটারচর থেকে আসাদগেট দিয়ে সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, পল্টন, কমলাপুর সায়দাবাদ হয়ে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত আরেকটি রুটেও বাস চলবে।
যারা বাধ্য হয়েই অধিক ভাড়া দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসগুলোতে যাতায়াত করছেন; তাদের দাবি দ্রুত অন্যান্য রুটেও রুট র্যাশনালাইজেশনের মাধ্যমে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চালু করা হোক। রাজধানীর সবগুলো রুটে ঢাকা নগর পরিবহণ চালু হলে যাত্রীরা নির্ধারিত ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবেন। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের হাফ ভাড়া নগর পরিবহণে শতভাগ কার্যকর করা হয়েছে। অথচ অন্যান্য রুটের অন্যসব বাসে ছাত্রছাত্রীরা হাফ ভাড়া দিতে চাইলে তাদের কার্ড দেখার নামে নানাভাবে হয়রানী করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন