‘পড়ুন’ এই অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়া দিয়েই আল্লাহপাক ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, আল্লাহর প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের উপর। সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘পড়ুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে, শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।’ পড়ার কত গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা থাকলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘ইকরা’ বা ‘পড়ুন’ শব্দটি দিয়ে ওহী শুরু করেছেন, তা সহজেই বুঝা যায়। আল্লাহর প্রথম ঐশী বাণীর তিন আয়াতের মধ্যেই দুইবার এই ‘ইকরা’ শব্দটি ব্যবহার করে মানব জীবনে পড়া বা অধ্যয়ন করার গুরুত্বকে সর্বোচ্চে তুলে ধরেছেন তিনি। শুধু তাই নয় মহাগ্রন্থ ‘কুরআন’ শব্দটির ধাতুমূলও একই অর্থ বহন করে অর্থাৎ পড়া, বার-বার পড়া বা আবৃত্তি করা ইত্যাদি। আল-কুরআনের অন্যান্য নামের মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘আল কিতাব’ অর্থাৎ বই। যদি আমরা পবিত্র কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দ ‘পড়ুন’ নিয়ে ভাবি তবে দেখা যাবে, এই অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়াটাই মানবজাতির মূল জ্ঞানতাত্ত্বিক বুনিয়াদ। সকল প্রকার জ্ঞানার্জন, সংরক্ষণ এবং বিতরণের এটি ঐশী নির্দেশ। বই হলো এ ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন ও সংরক্ষণের প্রাথমিক এবং মূল কেন্দ্রস্থল। মানবসন্তান হয়ে জন্ম নিলেই মানবজীবন সার্থক হয়ে উঠে না। মানব সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার জন্য জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। আর এই জ্ঞানের বাহন হচ্ছে বই। বই পড়া ব্যতীত প্রকৃত জ্ঞানার্জন সম্ভব নয় এবং পৃথিবীকে চেনা-জানা সম্ভব নয়। জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান। অজ্ঞতা অন্ধকারের শামিল। তাই আলোকিত মানুষ হতে হলে ‘পড়ার’ বিকল্প নেই। সভ্য, সুন্দর ও মানবিক সমাজের প্রধান উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষা বা জ্ঞানের অভাব সমাজকে কতটা তমসাচ্ছন্নতায় নিমজ্জিত করে, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে মরুময় আরবে মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম আইয়ামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকারের যুগ। সেই যুগে সূর্য ঠিকই উদিত হতো, পৃথিবী সূর্যালোকে আলোকিত হতো, তথাপিও যুগটাকে ‘অন্ধকারের যুগ’ হিসেবে ইতিহাসে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। তার কারণ হলো, শিক্ষা বা জ্ঞানের অনুপস্থিতি। সেই অন্ধকার যুগের গভীর তমসাচ্ছন্নতাকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকার মাধ্যমে দূরীভূত করে সত্যিকার অর্থে এক আলোকোজ্জ্বল সমাজের গোড়াপত্তন করা হয়েছিল। সেই সমাজে দীর্ঘকালের পুঞ্জীভূত তিমির সরাতে সর্বপ্রথম যে নির্দেশ অবতীর্ণ হয়েছিল সেটি হলো, ‘পড়া’। কেননা, পড়ার মধ্য দিয়েই অর্জিত হয় শিক্ষা আর শিক্ষার চূড়ান্ত নির্যাস হলো জ্ঞান। মানুষকে যেসব উপাদান স্মরণীয়-বরণীয় করে তোলে বই তার ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। রুচিশীল মানুষের চিন্তা ও সৃজনশীলতা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বই। বই হলো জ্ঞানাহরণের চারণভূমি। এখানে যে যত বেশি বিচরণ করবে তার জ্ঞানের পরিধি তত ব্যাপৃত হবে। প্রখ্যাত ইরানি কবি আব্বাস ইয়ামেনি শারিফ বলেন, ‘একটি ভালো গ্রন্থ মানবজীবনের প্রয়োজনীয় কথামালার এক বিচিত্র গাঁথুনি, অজস্র উপদেশের ভাণ্ডার আর বর্ণনাতীত উপকারের আকর।’ ইতিহাসখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও কবি উমর খৈয়াম বলেছেন, ‘গ্রন্থ হচ্ছে অনন্ত যৌবনা। মদের নেশা একসময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, রুটির চাহিদা ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কাজল কালো আঁখিও এক পর্যায়ে ঘোলাটে হয়ে পড়বে; কিন্তু বইয়ের কদর কখনও হ্রাস পাবে না।’ টলস্টয় মানবজীবনের অতীব প্রয়োজনীয় তিনটি জিনিসের উল্লেখ করেছেন, যার প্রথমটি বই, দ্বিতীয়টি বই এবং তৃতীয়টিও বই। বাঙালির জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমাকে মারবার জন্যে ধারালো অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র বই থেকে দূরে রাখলেই চলবে।’ আর নর্মান মেলরের তো প্রার্থনাই ছিল যে, বই পড়া অবস্থায় যেন তার মৃত্যু ঘটে। বই শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের বাহন নয়, বরং জীবনঘনিষ্ঠ অনেক উপকার করে। যেমন, বই আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়, মস্তিস্ক ঠান্ডা রাখে, মানসিক চাপ কমায়, প্রেরণা যোগায়, সৃজনশীলতা বাড়ায়, মনকে তীক্ষ্ণ করে তোলে, শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, কল্পনা শক্তি বাড়ায়, দুশ্চিন্তা হ্রাস করে, ঘুমে প্রশান্তি আনে, আমাদের সামাজিক করে তোলে, নৈতিকতা বৃদ্ধি করে এবং অধিকতর স্মার্ট করে তোলে। ধর্মীয় নির্দেশ এবং জীবনের জন্য অপরিহার্য বিষয় হওয়া সত্ত্বেও আজ আমরা বই পড়া থেকে অনেক দূরে চলে গেছি, যা সত্যিই হতাশাজনক। বইয়ের সাথে আমাদের অনেকের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। অথচ, বই পড়ার মধ্যেই সভ্যতা, সফলতা ও সৌন্দর্য নিহিত। অতীতে সেই সাফল্য ছিল যথাযথ। ফ্রান্য রনসেনথাল তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘জ্ঞানের ধারণা ইসলামে অর্জন করেছিল অনন্য এক সাফল্য। আর এই সাফল্য অর্জন হয়েছিল অনবরত বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকে এবং বৈচিত্রময় রকমারি সব বই থেকে স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে। যেসব বইয়ের মধ্যে এমন অনেক বইও ছিল যেগুলো ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীত।’ কহড়ষিবফমব ঞৎরঁসঢ়যধহঃ: ঞযব ঈড়হপবঢ়ঃ ড়ভ কহড়ষিবফমব রহ গবফরবাধষ ওংষধস. ‘বইপড়া’ সংস্কৃতির অভাবে আজ সব ধরনের জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে। সভ্যতা যেন প্রযুক্তির লাইক, শেয়ারে এসে থমকে গেছে। এসব বিভিন্ন মিডিয়াও জ্ঞানের উৎস বটে তবে তা কখনো বইপড়া বা সমাজের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির বিকল্প হতে পারে না। আজকে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষা পাশের জন্য পড়া বা চাকরি পাওয়ার জন্য ডিগ্রি অর্জনের যেই সংস্কৃতি তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং মোবাইল আসক্তি কমিয়ে বই পড়ার প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ করতে হবে নতুবা জ্ঞানের রাজ্যে আমরা বড় অসহায় হয়ে পড়বো এবং পিছিয়ে পড়বো প্রতিযোগিতাময় বিশ্ব থেকে। আর বইয়ের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উত্তম, সফল, অবিকৃত এবং সকল সমস্যার সমাধান সম্বলিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআন, যা মানবজাতির জন্য মহান রাব্বুল আলামীন প্রেরণ করেছেন পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে। সৃষ্টির পরতে পরতে রয়েছে স্রষ্টার অপার মহিমা ও অনন্তকালের অফুরান জ্ঞানভাণ্ডার। এই জ্ঞানভাণ্ডারে ডুব দিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে হলে, স্রষ্টার মহিমা বুঝতে হলে বেশি বেশি পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে।
জ্ঞানচর্চা তথা বই পড়া থেকে দূরে সরে গিয়ে আজ আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দিন দিন অজ্ঞতার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। এই দূরাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের তো তপস্যাই হলো অধ্যয়ন বা পড়া। তাই বইয়ের সাথে আমাদের মেলবন্ধন বহুলাংশে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে বই উপহার দেয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে। সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে অন্যান্য সামগ্রীর বদলে বই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাবলিক লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে সকলের বই পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ‘বই পড়া’ প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি সকলের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হলে আলোকিত জীবন গড়া সহজ হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন