দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের রক্ষণশীল শহর দায়েগুতে একটি মসজিদ নির্মাণ সংক্রান্ত বিরোধ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা দেশটির ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যময় সমাজের ইসলামবিদ্বেষী চিত্রটি তুলে ধরেছে। প্রায় ১শ’ ৫০ জন মুসলিম, যাদের বেশিরভাগই নিকটবর্তী কিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র, প্রায় এক বছর আগে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করে। তাদের কোরিয়ান প্রতিবেশীরা এটা জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে প্রচার করতে শুরু করে যে, মসজিদটি দাহেয়ন-ডং-এর আশেপাশের এলাকাটিকে মুসলিমদের একটি ছিটমহল এবং একটি অপরাধ-প্রবণ বস্তিতে পরিণত করবে। তারা এও দাবি করে যে, এটি একটি অপরিচিত সংস্কৃতি থেকে আরও শব্দ এবং খাবারের গন্ধ বয়ে আনবে, যা কোরিয়ান বাসিন্দাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।
মুসলিম ছাত্ররা এবং তাদের কোরিয়ান সমর্থকরা পাল্টা যুক্তি দেয় যে, দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল শহর দায়েগুতে তাদের শান্তিতে বসবাস ও প্রার্থনা করার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তান থেকে আগত কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডির ছাত্র মুয়াজ রাজ্জাক বলেন, ‘বিক্ষোভ এবং হয়রানির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তারা যা করছিল তা হল হয়রানি।’ দায়েগুতে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সঙ্ঘাত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি অস্বস্তিকর সত্য উন্মোচিত করেছে। তা হল, অভিবাসী বিরোধী উন্মাদনা এবং ইসলাম বিদ্বেষের ভয়ানক স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এবং এটি এমন একটি সময়ে ঘটছে, যখন দেশটি তার সংস্কৃতিতে, যারবাহন, প্রযুক্তি এবং স্মার্টফোন কিনতে আগ্রহী সারা বিশ্বের ভোক্তাদের ওপর আগের চেয়ে আরও বেশি বৈশ্বিক প্রভাব উপভোগ করছে। এটি যদিও দেশটি সফলভাবে তার সংস্কৃতিকে বিদেশে রপ্তানি করছে, তবে এটি স্বদেশে অন্যান্য সংস্কৃতিকে স্বাগত জানাতে অনাগ্রহী।
দক্ষিণ কোরিয়ার মুসলিমরা প্রায়শই বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। বিশেষ করে ২০০৭ সালে তালেবানরা দুইজন দক্ষিণ কোরিয়ান ধর্মপ্রচারককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর। ২০১৮ সালে দেশটির জেজু দ্বীপে ৫ শ’ ইয়েমেনি আশ্রয়প্রার্থীর আগমন দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম সংগঠিত অভিবাসী বিরোধী বিক্ষোভের সূত্রপাত করে। সরকারের ওপর এই অভিযোগ তোলা হয় যে, দেশটির সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের দ্বীপ ছেড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। দায়গুতে মসজিদের বিরোধিতাকারী এবং দেশব্যাপী অভিবাসন বিরোধী নেটওয়ার্ক রিফিউজি আউট-এর নেতা লি হিউং-ওহ বলেন, ‘শুধু হিজাবের উপর তাদের নিয়মই যথেষ্ট কারণ যে, তাদের কখনই আমাদের দেশে পা রাখা উচিত নয়।’ যারা মসজিদ এবং অভিবাসনের বিরোধিতা করে তারা প্রায়শই সতর্ক করছে যে, এসব বিদেশিদের আগমন দক্ষিণ কোরিয়ার ‘বিশুদ্ধ রক্ত’ এবং ‘জাতিগত একতাকে’ হুমকির মুখে ফেলবে।
দ. কোরিয়াতে বছরের পর বছর কম জন্মহার এবং শহরাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান আয়ের কারণে যারা বিয়ে করতে চায় এবং গ্রামীণ শহরে বসবাস করতে চায় তাদের অভাব দেখা দিয়েছে। খামার এবং কারখানাগুলি কম বেতনের চাকরিতে কর্মী পাওয়া কঠিন বলে মনে করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের অভাব রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলি উপশম করতে সাহায্য করার জন্য দেশটির সরকার অন্যান্য দেশের শ্রমিক এবং ছাত্রদের জন্য তার দরজা খুলে দিয়েছে। কিছু গ্রামীণ পুরুষ বিদেশী নারীদের বিয়ে করতে শুরু করেছে, বিশেষ করে ভিয়েতনাম থেকে। তবুও যখন সরকার ‘বহু-সাংস্কৃতিক পরিবারকে’ সমর্থন করার জন্য নীতি প্রবর্তন করল, তখন একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটল এবং হঠাৎ করে, ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ এবং ‘বৈচিত্র্য’ এর মত শব্দগুলি অনেক দক্ষিণ কোরিয়ানদের জন্য নিন্দনীয় শব্দ হয়ে উঠল।
গত বছর একটি চীন বিরোধী বিদ্রোহ স্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে সিউলের পশ্চিমে একটি চীনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য করেছিল। সিউলের দক্ষিণে আনসানে ওনগক এলিমেন্টারি স্কুলের ৪ শ’ ৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জন ছাড়া বাকি সবাই অভিবাসীদের সন্তান হওয়ায় কোরিয়ান অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সেখানে পাঠাতে অস্বীকার করেন। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অসাদাচার পর্যবেক্ষণকারী মানবাধিকার আইনবিদ হায়াং পিল-গিউ বলেন, ‘এটি এক বিষয় যে, কোরিয়ানরা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হতে চায়, বিদেশে ধনী এবং সফল হতে চায়। তারা বিদেশীদের আলিঙ্গন করতে ইচ্ছুক কিনা তা অন্য বিষয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন