রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো। রোগ হলে রোগীর কষ্ট, চিকিৎসা, ওষুধ ইত্যাদিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় হলো তার জীবন। তাই সবার হৃদয় জুড়ে থাকে বেঁচে থাকার বাসনা। খাদ্য ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ বিশ্বচরাচরে খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে এমন কোন জীব নেই। প্রতিটি জীবের জন্য চাই খাদ্য। তাই মানুষ স্বভাবগত নতুন বিষয়ে আগ্রহী থাকে। নতুনত্ব নিয়ে আসতে চায় সব ক্ষেত্রে। তাই খাদ্যের নতুন ও আকর্ষনীয় ভাব মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। জিহ্বার স্বাদ যে অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়, সেটা আমাদের অনেকেরই জানা। তাই আসুন, জেনে নিন ফাস্টফুড স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে- বিশ্বব্যাপী আজ ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার।
ফাস্টফুড আমাদের সবার জন্য হুমকি। তাই বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই ফাস্টফুড খেয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী উদ্যোগেথ ‘মডার্ন ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড ডায়াবেটিস’ শীর্ষক এক মহা আন্দোলন। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সব দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের সম্মেলনে বাংলাদেশও অংশ নেয়। বাংলাদেশের একদল বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সবাই একসাথে ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সেখানে বিশেষজ্ঞেরা বলেন- ইদানীং সব দেশের সব বয়সী ছেলেমেয়েরা ফাস্টফুডের কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বেড়ে চলেছে। শৈশব স্থুলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু শিশু- কিশোর নয়, সব বয়সের মানুষ ফাস্টফুড খেয়ে নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীতের মাঝে ফাস্টফুডের ক্রেতা। তারা এগুলো খেয়ে মোটাসোটা হয়ে ওজন বাড়াচ্ছে। তাদের রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাড়ছে ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, ক্যান্সার,বন্ধ্যত্ব, হাঁপানি ও দীর্ঘমেয়াদি পেটের জটিল রোগ। তবে ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।
ব্রিটেনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ফাস্টফুড বিক্রেতা হলো ম্যাকডোনাল্ড। এই কোম্পনির বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। সেখানে ফাস্টফুডের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। ডকুমেন্টারি সিনেমা তৈরি করে দেখানো হচ্ছে। কিছু দিন আগে ফাস্টফুডের অপকারিতা সম্বদ্ধে তৈরি সিনেমা ‘সুপার সাইজ সি’ দেখানো হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে কিভাবে কিছু ব্যক্তি একাধারে ত্রিশ দিন ফাস্টফুড খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছে। তাদের লিভার ইনফেকটেড হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ফাস্টফুড কত অস্বাস্থ্যকর ওরাই তার প্রমাণ। ওবেসিটি আক্রান্ত দুই স্কুল দুই ছাত্রী ব্রিটেনে ফাস্টফুড বিক্রেতা ম্যাকডোনাল্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পিৎজা, বার্গার, বড় সাইজের চকোলেট, প্যাকেটজাত জুস সবই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। জুস তো আসলে বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক মিশ্রণ, জুস নয়। এছাড়া বাজারে বিক্রি হচ্ছে নানা নামের কোলা। এগুলো আবার নানা রঙের। এগুলোর উপকরণ নানা প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য যা ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এগুলোর বিরুদ্ধেও চলছে নানা প্রচারণা। ফলে সে দেশে ফাস্টফুডের বিক্রয় কমছে।
ফলমূলের বিক্রয় ও চাহিদা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন ফাস্টফুড তৈরি ও বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান জানিয়েছে। স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের ডেকে সম্মেলন করে এসব ফাস্টফুডের অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওর জার্নাল অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনের মতে, অক্সফোর্ডের একদল গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন, যারা নিয়মিত ফাস্টফুড খান এবং কোলা পান করেন তারা বেশির ভাগ হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। মোটাসোটা হয়ে ওজনে ভারী হয়। চীনের করনেল বিশ^বিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি প্রধান তার গবেষণায় দেখেছেন, ফাস্টফুড খায় যারা তারা বেশির ভাগ হতাশ, উদাস, উদ্যমহীন, সর্বদা ক্লান্ত ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় একদল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখেছেন, ফাস্টফুড খায় যারা তারা আশঙ্কাজনক হারে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ভারতে বিভিন্ন স্কুল কলেজের অধ্যক্ষরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ফাস্টফুডের দোকান নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। অভিভাবকদের ডেকে ফাস্টফুডের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরছেন।
বাংলাদেশের শহরগুলোর অলিগলি পাড়া- মহল্লায় ফাস্টফুডের দোকান গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো। এখানে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ভিড় জমাচ্ছে। তারা জানে না কী খাচ্ছে; এগুলো কী কী ক্ষতি করে। এসব ফাস্টফুডে খাসি ও গরুর চর্বি গলিয়ে দিয়ে মুখরোচক করা হয়। বহু দিনের পোড়ানো কালো তেলে ভাজা। দু-তিন দিনের বাসি পিৎজা, বার্গার গরম করে খাওয়ায়। এসব খেলে ওবেসিটি বা স্থূলতা বাড়ে, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস হয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ের স্কুল সকাল সাড়ে ৭টায়। তখন মায়েরা আরামের ঘুম মাটি করতে চান না। শিশুকে রাতেই নাস্তার টাকা দিয়ে দেন। শিশু স্কুলে গিয়ে ক্যান্টিন থেকে ওই ফাস্টফুড কিনে খায়। রোজ খেতে খেতে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা ও বমি হয়। তারপর হাসপাতালে। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা বেশি ফাস্টফুডে আসক্ত। তাই আজকাল বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক, আলসার ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে।
ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত ন্যাশনাল ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক বলেন, পুরনো পোড়ানো কালো তেলে ভাজা ফাস্টফুড ক্যান্সার উপাদান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি সবাইকে ফাস্টফুড খেতে নিষেধ করেন। ঢাকার শিশু হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ফাস্টফুড এবং ভাজাপোড়া খাদ্য নারী ও শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। গর্ভবতী মাদের গর্ভস্থ শিশুরা বিকলাঙ্গ ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করছে ওই ফাস্টফুডের জন্য। আজকাল স্কুলের ছোট শিশু দীর্ঘমেয়াদি পেটের অসুখ, লিভার ও কিডনি রোগ নিয়ে হাসপাতালে আসছে। এর বেশির ভাগ ওই ফাস্টফুডের শিকার। যেসব মহিলা ও যুবতীরা ফাস্টফুডে আসক্ত, তারা ওবেসিটি ও বন্ধ্যত্ব নিয়ে হাসপাতালে আসছে।
একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, যেসব মহিলা ও তরুণীরা ওই বহু দিনের পোড়ানো কালো তেলে ভাজা সিঙ্গাড়া, সমুচা, নিমকি, পিজা, বার্গার খেয়ে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ গ্যাস্ট্রিক, আলসার জটিল পেটের পীড়া, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা পেপটিক আলসার রোগী তাদের জন্য ফাস্টফুড রীতিমতো বিষ। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের ফাস্টফুড নিষিদ্ধ করা উচিত।
ইদানীং শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরণী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি দ্রুত ফাস্টফুড নিয়ন্ত্রণ না করেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালমৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। আমাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ফলমূল খেতে উৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।
মো. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট
মোবাইল: ০১৭১৬-২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন