বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি কি আবার বাধাগ্রস্ত, আপাতত এ প্রশ্নেই তা ঘুরপাক খাচ্ছে। গত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার জন্য আমাদের যে যাত্রা, তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ। এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থসংস্থানের প্রধান উৎস হওয়া উচিত শেয়ারবাজার। একটি সুষ্ঠু, স্থিতিশীল শেয়ারবাজার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটি সম্ভব। শেয়ারবাজার যত ভালো অবস্থানে থাকবে, ক্ষুদ্র উদ্ভাবনী কোম্পানিগুলো সেখান থেকে তত বেশি মূলধন সহায়তা পাবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হবে। এ কথা তো সবার-ই জানা, শেয়ারবাজার কখনো সরলরেখায় চলে না। শেয়ারবাজারের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে বহু রকমের উত্থান-পতন তথা লাভ-লসের গল্প। আশা-নিরাশার এ পথ সব সময়ই বন্ধুর। নানা খানা-খন্দে ভরা। শেয়ারবাজারের সফলতার পথে রয়েছে অসংখ্য বাঁক। বাঁকবদলের প্রতিটি পর্বেই থাকে লাভÑলসের সম্ভবনা। তা মূর্খ বা অল্প জানাশোনা লোকের পক্ষে বুঝে চলা মুশকিল।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ জ্ঞান না থাকলে বিনিয়োগকারীরা হরহামেশাই এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খায়। এখানে টান টান রশির ওপর অতিসচেতনভাবে পা ফেলতে হয়। তবে কি জ্ঞানীরা সফল? না, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে এত সরলীকরণও করা যায় না। থাকতে হয় অনুসন্ধানী চোখ, তথ্যবহুল জ্ঞান, লেগে থাকার ক্ষমতা ও একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০২১ সালের শেষ কোয়ার্টারে এসে আমাদের শেয়ারবাজারে কিছু অস্থিরতা দেখা দিলেও ২০২২ সালের শুরুটা ছিল বেশ ভালোই। নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা আবার সক্রিয় হতে শুরু করে। সাধারণত বাজারে যখন মন্দাভাব বা দরপতন দেখা দেয়, তখন নিষ্ক্রিয় হিসাবের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন অনেক বিনিয়োগকারী তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। আবার বাজারে যখন ঊর্ধ্বমুখী ভাব বা গতি সঞ্চার হয়, তখন নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা আবার সক্রিয় হতে শুরু করে, যা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মূলনীতির পরিপন্থী। বিনিয়োগে এই আচরণ সাধারণত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বেশি দেখা যায়। যত বেশি বিনিয়োগকারী বাজারে সক্রিয় থাকবে, বাজার ততই গতিশীল হবে।
গত ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ২০ লাখ ৩৯ হাজার ৩১৩টি। এর মধ্যে শেয়ার ছিল ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৪১৮টিতে। পুরোপুরি শেয়ারশূন্য ছিল ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮টি অ্যাকাউন্ট। বাকি ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৭টি অ্যাকাউন্টে কখনই শেয়ার কেনাবেচা হয়নি। ওই হিসাবে আমাদের দেশে কমবেশি শেয়ার কেনাবেচা করে, এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ১২ শতাংশ। অথচ, চীনের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ শেয়ারবাজারে সম্পৃক্ত। আবার আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ধরনও একটু ভিন্ন রকমের। এরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে পোর্টফলিও সাজানোর ক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো রকম নিয়মনীতি বা কৌশলের তোয়াক্কা করে না। হুটহাট করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো বিনিয়োগ করে। তবে সময়ের সাথে সাথে বাজারের গতি বা ধরন অনুযায়ী কিছু লাভের চেষ্টা করতেই পারে। হয়তো-বা কেনাবেচার মাধ্যমে লাভবান হওয়াও সম্ভব। বিনিয়োগকারীদের দিক থেকে এই আগ্রহটুকু থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এর সবচেয়ে নেতিবাচক ও ভয়ঙ্কর দিক হলো, এই প্রবণতা তাকে ধীরে ধীরে লোভী ও ফটকাবাজির দিকে ঠেলে দেয় এবং ফটকাবাজিই হয়ে ওঠে বিনিয়োগকারীর সর্বনাশের মূল কারণ।
আবার দুই-চারজন যে এর ব্যতিক্রম হবে না, ব্যাপারটা এমন নয়। তবে এই ব্যতিক্রম কখনো বিনিয়োগের আদর্শ হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহত দরপতনের প্রেক্ষাপটে গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৫ কার্যদিবসে ৯৬ হাজার ১৫ বিও অ্যাকাউন্টধারী শেয়ার বিক্রি করে সেগুলো পুরোপুরি খালি করে। অথচ, বছর শেষে অনেক কোম্পানির, বিশেষ করে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা খাতে লভ্যাংশ ঘোষণার সময়। এর পর আবার গত ৯ জানুয়ারি একদিনেই ৭৬ হাজার ৭০২ অ্যাকাউন্টে ফের শেয়ার যোগ হয়। ফলে সূচকও তথাকথিত একটি মাইলফলকের আশপাশে ঘুরপাক খায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই একটি মাইলফলকের অপেক্ষায় থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, মনস্তাত্ত্বিক এই মাইলফলকের স্তরে সূচক পৌঁছাবে কীভাবে, যদি এভাবে বিনিয়োগকারীদের নিজেদের সমুদয় শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থাকে। এ যেন মাঠে না নেমেই খেলোয়াড়দের গোল দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না করে সূচক ধরে রাখা অথবা স্থিতিশীল বাজার প্রত্যাশা।
আমাদের বিনিয়োগকারীরা জানে-ই না, তারা (বাছবিচার ছাড়াই) কী শেয়ার বিক্রি করছে? আর কেনই বা বিক্রি করছে? তাদের একটি আবেগপ্রবণ ধারণা হলো, এই শেয়ার তারা আরও কম দামে কিনতে পারবে। যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে এই বেপরোয়া আচরণ করছেন, তাদের কি বিনিয়োগকারী বলা যায়? ফটকাবাজিরও ন্যূনতম একটা নৈতিক বোধ থাকা উচিৎ। যদিও শেয়ারবাজারের ভাষায়, যে ব্যক্তি সিকিউরিটি কেনাবেচা করে, তাকে আমরা বিনিয়োগকারী বলে থাকি, সে যা-ই কিনুক, যে উদ্দেশ্যে কিনুক, যে মূল্যে কিনুক, যত কম সময়ের জন্য-ই কিনুক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও ফটকাবাজির পার্থক্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আমরা নিজেদের কী হিসেবে দেখতে চাই, বিনিয়োগকারী, না ফাটকাকারবারি।
আশা করি, বিনিয়োগকারীদের বোধোদয় হবে। অন্যথায় অজান্তেই ফটকাবাজিতে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত তো করবেই, সার্বিক বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার এর ফলে লেনদেনেও দেখা দেয় এক প্রকার অস্থিরতা। লেনদেন কম হলে বাজার স্থবির হয়ে পড়ে। বাজার হারায় নিজস্ব স্বকিয়তা। আমাদের শেয়ারবাজারে তারল্যের পরিমাণ সমপর্যায়ের দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম। আমাদের যেখানে গড়ে দিনে এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের শেয়ার হাতবদল হয়, সেখানে ভিয়েতনামে এর পরিমাণ ৬-৭ হাজার কোটি টাকা। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, ওই বিচারে আমাদের শেয়ারবাজারের এ দুরবস্থা ডিজার্ভ করে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই দুরবস্থা? সহজ উত্তর-সুরক্ষা নেই। যেখানে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নেই, সেখানে তারা কেন আসবেন? তাই মূল কাজটি করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার, আর সেটি হলো বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা। সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এখানে আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়, কোন ধরনের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে? অবশ্যই প্রশিক্ষিত, অর্থনৈতিক ন্যূনতম জ্ঞানসম্পন্ন সচেতন ব্যক্তি।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন