রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে

ভারতীয় চ্যানেল রুখতে মিডিয়া ইউনিট

প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : শিরোনাম ধার করতে হলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’। অভিনন্দন জানাতে হয় যেমন ইনকিলাবকে; তেমনি দীর্ঘদিন পর যাদের ঘুম ভাঙলো টিভি মিডিয়ার সেই অংশীজনদের। ভারতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি হুমকির মুখে। ভারতীয় চ্যানেলের অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রচারণা এবং বাংলাদেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলে প্রকাশ করায় দেশের কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা হয়ে ভারতে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অপসংস্কৃতি ও হিন্দীর আগ্রাসনে হারিয়ে যাবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এটা অশনি সংকেত। কয়েক বছর ধরে ইনকিলাবে এ নিয়ে জনসচেতনতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মিডিয়ার অংশীজনদের সতর্ক করলেও কেউ এসব কানে তোলেননি। বরং এ সব লেখালেখিকে একবাক্যে ‘ভারত বিরোধী’ হিসেবে প্রচার করার প্রয়াস পেয়েছে। নাটক-সিনেমার কিছু শিল্পী-কলাকুশলী মাঝে মধ্যে এসবের প্রতিবাদ করলেও এ সেক্টরের নীতি নির্ধারক ও জাঁদরেল ব্যক্তিত্বরা কার্যত ছিলেন ‘নীরব’। দেরিতে হলেও শিল্প-সংস্কৃতির অংশীজনরা ভারতীয় অপসংস্কৃতি প্রচার ও বিজ্ঞাপনের নামে ভারতে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
বিদেশী অপসংস্কৃতি রোধ এবং দেশের গণমাধ্যমের স্বার্থরক্ষায় ‘মিডিয়া ইউনিট’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওই সংগঠন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন প্রচারের নামে টাকা পাচার বন্ধের দাবি জানিয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। গত শনিবার রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সংগঠনের নেতারা বলেছেন, নভেম্বরের পর ভারতীয় কোনো চ্যানেলে দেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার হলে তা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা হবে। দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়ালের সম্প্রচার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন। এর ফলে একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতির মুখে পড়ছেন দেশীয় চ্যানেল, শিল্পী ও কলাকুশলী। তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্প রক্ষায় দেশে বিদেশি চলচ্চিত্র প্রচারের ক্ষেত্রে ল্যান্ডিং ফি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে মিডিয়াঙ্গনকে সুসংঘবদ্ধ রাখতে শৃংখলিতভাবে পরিচালনার কথা বলেন তারা। ওই আলোচনা সভায় যে তথ্য দেয়া হয় তাহলোÑ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিবেশী ভারতে চালানোর ক্ষেত্রে রাজ্যভেদে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ল্যান্ডিং ফি দিতে হয়। অথচ ভারতের চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে অনুমোদন ছাড়াই অবাধে চলছে। ল্যান্ডিং ফি তো দূরের কথা কোন কোন চ্যানেল মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত অনুমতি নিলেও অনেকের তাও নেই। বাংলাদেশে দেখা যায় এমন অনেক ভারতীয় চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার হয় না। শুধু বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন সেক্টরের টাকা আত্মসাতের জন্য জন্ম দেয়া হচ্ছে ভারতীয় এসব চ্যানেল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন সেক্টরের টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
ওই সভায় দেশের বিভিন্ন চ্যানেলের মালিকের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনয় শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বাংলাদেশের নাটক রক্ষায় সবার সহযোগিতা চান। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, বাংলাদেশের টাকা দিয়ে বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশের চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। সেগুলো বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য প্রচার হচ্ছে। অথচ এগুলোর বৈধ অনুমোদন নেই। অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ভারতের টিভি বাংলাদেশে চলবে আর বাংলাদেশের টিভি ভারতে চলবে না, এটা হতে পারে না। অথচ সেটা হচ্ছে। তাহলে কি আমাদের দেশে বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে হিন্দি ভাষা শেখানোর প্রবণতা শুরু হলো? অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, বন্ধু হয়ে অন্য বন্ধুকে কেউ জিম্মি করতে পারে না। বন্ধুর শত্রু কারো বন্ধু হতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতিকে জিম্মি করা হচ্ছে। বিজয় টিভির পরিচালক মহিবুর হাসান চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞাপনের নামে বিদেশে একশ’ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। হাইকোর্ট যেমন নির্দেশনার মাধ্যমে গার্মেন্টস বায়ারদের বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করেছে; সেভাবে এ সেক্টরে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। ইমার মহাসচিব রঞ্জন কুমার দত্ত বলেন, ইতোমধ্যে একশ’ কোটি টাকা বিজ্ঞাপনের নামে পাচার হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এটা বন্ধ করা না গেলে এই প্রবণতা আরো বাড়বে। পরিচালক গাজী রাকায়েত বলেন, আমরা এখনো নিজের সংস্কৃতিকে সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারিনি। বিদেশি অপসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছি। নিজের সংস্কৃতিকে সিস্টেমের মধ্যে এনে বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ‘মিডিয়া ইউনিটি’র আহ্বায়ক মোজাম্মেল বাবু বলেন, আইনের ফাঁকে বাংলাদেশের টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিতে হবে। বাংলাদেশের মিডিয়া জগত অপসংস্কৃতিতে দখল করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনা শূন্যতা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এর ফলে এদেশের যুব সমাজকে মস্তিষ্ক শূন্য করে দেয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মাদকাসক্তি, অনৈতিকতা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন যারা বিদেশের চ্যানেলে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। এরপর থেকে যেনো তারা আর কোনো রকম বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে না দেয়। তারপরও যদি সেটি করা হয়, তাহলে আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করবো।
ঢাকা ক্লাবের ওই আলোচনা সভায় এক বক্তা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, আমরা এখান থেকে বের হয়ে গিয়ে ‘ঐক্যবদ্ধ’ থাকতে পারবো তো? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ওই সভায় অনেক আলোচক ‘ভারত’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তারা বার বার বলেছেন ‘বিদেশি’ চ্যানেল। এ যেন ‘ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই’ প্রবাদের মতোই। বোঝা যায় ভারতীয় মিডিয়ার সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া তাদের পক্ষে কত বিব্রতকর।
সংস্কৃতি একটি জাতির বড় পরিচয়। জাতি গঠনে ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এই সংস্কৃতি বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের স্বদেশী সংস্কৃতির সমৃদ্ধ। অথচ বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর কোথাও যেন স্বদেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মা-মাটি ও মানুষের কৃষ্টি-কালচারে সমৃদ্ধ জাতি হয়েও বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়ায় ক্রমান্বয়ে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। জারী-সারী-মুর্শিদী-ভাটিয়ালী, হাছন-লালন-নজরুল-আলিম-আব্বাস-জসীম-শিল্পাচার্য জয়নুলের দেশে এখন বিজাতীয় সংস্কৃতির রমরমা প্রসার। হামদ-নাত-কাওয়ালী-গম্ভীরাও কম সমৃদ্ধ নয়। ভারতের প্রতি নতজানু মানসিকতার কারণে ক্রমান্বয়ে যেন আচ্ছন্ন কয়ে পড়েছি হিন্দি সংস্কৃতির দিকে। মার্কেট, হোটেল, বাস, ট্রেনে এমনকি আজকাল বাসের কন্ডাক্টর-রিকশাওয়ালা-নৌকার মাঝিদের কণ্ঠেও হিন্দি ছাড়া বাংলা গান শোনা যায় না। ভালোভাবে কথা শেখার আগেই শহর-গ্রামের শিশুর কণ্ঠে শোনা যায় হিন্দি গান, সিনেমা ও সিরিয়ালের ডায়লগ। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও বাজানো হয় হিন্দী গান। নিজ ঘরে টিভি পর্দায় চলছে ভারতীয় চ্যানেল। ভারতীয় চ্যানেলের প্রবল দাপটে আমাদের নাটক ও চলচ্চিত্র প্রায় লাটে উঠেছে। হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির রমরমা রাজত্ব চলছে দেশে। এতে নিজস্ব সংস্কৃতি তো বটেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। সংস্কৃতির কারণে হোক আর বিজ্ঞাপনের নামে অর্থ পাচার বন্ধের দাবিতেই হোক দেরিতে হলেও চ্যানেল মালিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি উদ্যোগ নিয়েছেন; এটা ভাল। ‘মিডিয়া ইউনিট’ সফল হোক এ প্রত্যাশা রইলো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন