শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পর্দাসংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০৮ এএম

পর্দা আধুনিক যুগে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের কাছেই শব্দটি ব্যাপক পরিচিত। আরবীতে যাকে হিজাব বলা হয়ে থাকে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো, বস্ত্রাদি নির্মিত আবরণ, আচ্ছাদন, অন্তরাল ইত্যাদি। পরিভাষায়, চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে নারী ও পুরুষের মাঝে ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত আবরণকে পর্দা বলে। ইসলামী সমাজে নারীর মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এ পর্দা। সৃষ্টির শুরু থেকেই মূল্যবোধের এ উপাদানটি প্রত্যেক সমাজেই চালু ছিল। মহানবী (সা.) এর আগমনের সময় থেকে এটি বিশেষভাবে মুসলিম সংস্কৃতির অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তাঁর আগমনের পূর্বেও আরব ভূখন্ডে এ পর্দা প্রথা বিস্তৃত ছিল। মহানবী (সা.) আগমনের পূর্বে আরব সমাজে ইহুদি, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করতো। এ সকল ধর্মের নারীরা ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে হিজাব পরিধান করতো। আধুনিক বিশ্বে কোনো নারী যখন বোরকা কিংবা হিজাব পরে, সাধারণত তাকে মুসলিম নারী বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিশ্ববাসীর এখন এটাই ধারণা যে, শুধুমাত্র মুসলিম নারীরাই বোরকা বা হিজাব পরিধান করে। হিজাব বিদ্বেষীদের অনেকে এটাকে মোল্লা-মৌলভীদের ধর্মীয় বাড়াবাড়ির ফল বলেও অপবাদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু হিজাবের ইতিহাস তা বলে না।

নারীদের শালীন পোশাক পরা ও শরীর আবৃত রাখা সকল ধর্মেরই ধর্মীয় বিধান। পর্দার এ বিধান শুধু নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পর্দা হলো নারীর ভূষণ ও অলংকার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রাচীন ভারতে নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথার প্রচলন ছিল। প্রাচীন আর্য সমাজের নারীরা পর্দার এ বিধান মেনে চলতো। ভারতের উত্তরপ্রদেশে বসবাসকারী আর্য কুমারী মেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন দুই খানা কাপড় পরিধান করতো। এ কাপড় দিয়ে তারা তাদের মাথা, মুখ ও দেহ ঢেকে রাখতো। এটা ছিল তাদের ধর্মীয় শাস্ত্রের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ। হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রেও পর্দার বিধানের আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু ব্রম্মা তোমাদের নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তাই তোমরা তোমাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী রাখবে, ঊর্ধ্বগামী নয়। আর নিজেদের পা সামলে রাখবে। আর এমন পোশাক পরবে যাতে তোমার দেহ কেউ দেখতে না পায়।’ (ঋগবেদ ৮/৩৩/১৯)। এ গ্রন্থের অপর এক শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘হে নারী! তোমার নাক যেন কেউ দেখতে না পায়! তুমি যদি এমন লজ্জাবতী হতে পারো, তাহলে নারী হয়েও তুমি সম্মানের পাত্রী হতে পারবে।’ (স্ত্রী ধর্ম: ১৪৭)।

হিন্দু শাস্ত্রের পর্দা অধ্যায়টি পাঠ করলে এ সম্পর্কিত আরও অনেক বিষয় জানতে পারা যায়। ধর্ম সম্পর্কীয় বিশিষ্ট গবেষক মাহমুদ শামসুল হক তার ‘নারী কোষ’ বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এক সময় হিন্দু নারীরা মশারির ভিতর বসে গঙ্গাস্নানে যেতো। ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম নারীরা অসুস্থ হলেও ঘেরাটোপের আড়াল থেকেই ডাক্তার দেখাতো। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু সমাজে অসূর্যস্পশ্যা নামে একটি শাস্ত্রীয় শব্দ চালু আছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, সূর্যের আলোও নারীদেরকে স্পর্শ করবে না।’ (নারী কোষ: পৃ. ১৭৭)। ঋগবেদে আরো বলা হয়েছে, ‘মহিলারা পুরুষদের মতো পোশাক পরতে পারবে না। আর পুরুষরাও তাদের স্ত্রীদের পোশাক পরিধান করবে না।’ (ঋগবেদ: অনুচ্ছেদ: ৮৫, পরিচ্ছেদ: ৩০)। এ সম্পর্কে হিন্দু শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীগণ পর পুরুষ তো দূরের কথা নিজের স্বামীর সামনেও বিবস্ত্র হতে পারবে না। হে কুমারী সকল! তোমরা নিজেদেরকে বহু লোকের ভোগের বস্তুতে পরিণত হইও না। তোমরা তোমাদের ঐ শরীরকে বহু পুরুষের চক্ষু ইন্দ্রিয় হতে সর্বদা আগলে রাখবে। এমন স্থানে তোমরা স্নান সম্পন্ন করিও যেখানে কোনো পুরুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না’ ইত্যাদি। বৌদ্ধ ধর্মও পর্দাপ্রথার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এ ব্যাপারে বৌদ্ধ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘ভুলেও পর পুরুষের প্রতি খারাপ মনোভাব নিয়ে দৃষ্টি দেবে না। পতিব্রতা ধর্ম উত্তমরূপে রক্ষা করবে। স্বামী প্রমুখ বাড়িস্থ অসুখ-বিসুখ সর্বদা খেয়াল রাখবে। আর এমনভাবে বস্ত্র পরিধান করবে যাতে উদর, পেট ও স্তন দেখা না যায়। সর্বদা পরিষ্কার কাপড় পরিধান করবে। পুরুষের সম্মুখে চুল আঁচড়াবে না, উকুনও ধরবে না।’ (গৃহনীতি পর্ব: নারীদের কর্তব্য: পৃ. ২৫২)। পর্দার ব্যাপারে গ্রিক সভ্যতাকেও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা যায়। এ সভ্যতা চর্চায় দেখা যায়, তাদের মাঝেও শালীন পোশাক পরার রীতি চালু ছিল। গ্রিক মেয়েরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন কাপড় দিয়ে তাদের মুখমন্ডল এবং দেহ ঢেকে রাখতো। (ঝযধসধহ ধহঃরয়ঁরঃব এৎবপয়ঁবংঃ, ঢ়. ৫৮৩)

পর্দার এ বিধান প্রাচীন ইহুদি নারীদের মাঝেও প্রচলিত ছিল। ইহুদী নারীদের সাধারণ পোশাকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল নেকাব। তৎকালীন এই নেকাব দিয়ে তারা মাথা, মুখমন্ডল এবং বক্ষদেশ আবৃত করে রাখতো। আবার কখনও কখনও এই নেকাব পায়ের নিম্নদেশ পর্যন্ত নেমে যেতো। (এনসাইক্লোপিডিয়া, পৃ. ৫২৪৭)। বাইবেল অধ্যয়ন করলে খ্রিস্টান নারীদের পর্দা প্রথা সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা পাওয়া যায়। খ্রিস্টান ধর্মে নারীদের পর্দার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শালীনতা না মানলে ইহকালে তাদের জন্য শাস্তির বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, ‘কোনো নারী যদি মাথা ও বুক ঢেকে না রাখে তাহলে তার মাথা মুন্ডন করে দিতে হবে। এটা যদি কোনো নারীর জন্য অপমানজনক হয় তাহলে সে নারী যেন মাথা ও বুক ঢেকে রাখে।’ (করিন্থীয়: ১১.৫ পদ)। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে বলা হয়েছে, ‘বিবিকা চোখ মেলে যখন ইসহাককে দেখলেন, তখন উটের পিঠ থেকে নেমে দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের সাথে দেখা করতে যিনি মাঠ দিয়ে হেঁটে আসতেছেন ঐ পুরুষ লোকটি কে? জবাবে দাস বললেন, উনি আমার মালিক। তখন বিবিকা অন্য এক টুকরা কাপড় দিয়ে নিজের মুখ ও দেহ আচ্ছাদন করলেন।’ (আদিপুস্তক: ২৪:৬৪, ৬৫ পদ)।

ইসলাম ধর্মের অনন্য মর্যাদাপূর্ণ এক বিধানের নাম এ পর্দা। আল-কোরআন মুমিন নারীদেরকে এ বিধান মানতে জোরালো নির্দেশ প্রদান করেছে। উম্মুহাতুল মু’মিনিন খ্যাত নবী (সা.) এর স্ত্রীগণও এর বাইরে নন। আল্লাহতাআলা তাদেরকে এ বিধান মানতে কঠোর নির্দেশ প্রদান করে আয়াত নাজিল করেছেন। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে, তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং সাজসজ্জা প্রদর্শন না করে; তবে যা নিজে প্রকাশ হয়ে যায় সেটা ছাড়া। তারা যেন তাদের উড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে এবং তাদের সাজ-সজ্জা (পর পুরুষের সামনে) প্রকাশ না করে।’ (সূরা আল মুমিনুন: ৩১)। ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদের বলে দিন যে, তারা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নেয় এবং একটি অংশ দিয়ে মুখের উপর লটকিয়ে দেয়। আর এটা হলো অধিক উপযোগী পদ্ধতি, যা দিয়ে তাদেরকে (সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও ভদ্র হিসেবে) চেনা যায়।’ (সূরা আহযাব: ৫৯)। হাদীস শরীফে পর্দার বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো তারা, যারা তাদের দেহকে শালীন পোশাকে আবৃত রাখে না এবং যারা দম্ভ করে চলে। এসমস্ত নারীরা হলো মুনাফিক। এরা লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের মতো। যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বায়হাকি: ১৩৪৭৮)। মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘জাহান্নামীদের মধ্যে একটি নারী দল থাকবে, যারা দুনিয়ায় পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকবে। এ উলঙ্গ পোশাক দিয়ে তারা তাদের দিকে অন্য পুরুষকে আকৃষ্ট করবে। আর নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। কেয়ামতের দিন তাদের মাথা হবে উটের পিঠের কুঁজের মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম: ২১২৮)।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায় যে, পর্দাপ্রথা সুদূর প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধান। কোনো ব্যক্তি বিশেষের মনগড়া নির্দেশিত বিধান এটি নয়। উপরে আলোচিত ধর্মগুলোর মধ্যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম হলো আসমানী ধর্ম। আর বাকি ধর্মগুলো হচ্ছে মানবরচিত। এ দু ধরনের ধর্মই পর্দা সংস্কৃতিকে ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয় যে, প্রাচীন প্রতিটি সভ্যতাই কোনো না কোনো ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। আর বর্তমান যুগেও ধর্মের সেই প্রভাব মানবগোষ্ঠির মাঝে বিরাজ করছে। আধুনিক মননশীল অনেক মানুষ এখনো ধর্মকে খুঁজে ফিরে চলেছে। মানবিক ও নৈতিক প্রশান্তি পেতে তাদের অনেকেই ধর্মের দ্বারস্থ হচ্ছে। সন্তানদের প্রকৃত ধর্ম শিক্ষা দিতে তারা বর্তমানে ইসলামী শিক্ষাকে বেছে নিচ্ছে। আর এ ধর্মের একটি মৌলিক শিক্ষা হলো চারিত্রিক বিশুদ্ধতা অর্জন। আর চারিত্রিক বিশুদ্ধতা অর্জনের অনন্য উপায় হলো শালীন পোশাক। আর জাত ও ধর্মভেদে এটা নারীজাতির এক ভূষণ ও অলংকার। বিশেষ ধর্মের নারীদের একক কোনো ভূষণ এটি নয়। আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে সকল ধর্মের নারীদের জন্য এটা অবশ্যই পালনীয়। তাই প্রাচীনকালের সকল ধর্মের সম্ভ্রান্ত রমণীরা হিজাব পরিধান করতেন। আধুনিক যুগেও বিভিন্ন ধর্মের নারীরা মর্যাদার এ প্রতীক হিজাব পরিধান করে থাকে। হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ নারীদের এ সংস্কৃতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। ভারতের উত্তর প্রদেশে এখনও অনেক নারী হিজাব পরিধানের নীতি অনুসরণ করে। ইউরোপের প্রায় সব খ্রিস্টান নানদের মধ্যে এখনও হিজাব প্রথার প্রচলন আছে। খ্রিস্টীয় বিভিন্ন হাসপাতালের সেবিকারাও এ পোশাক পরিধান করে থাকেন। এসব আলোচনা এটাই প্রমাণ করে যে, এটি বিশেষ কোনো ধর্মের বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির ফসল নয়। কিন্তু শুধুমাত্র প্রবৃত্তির ঘৃণ্য লালসার বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ এ সংস্কৃতির বিরোধিতা করে থাকেন। ঘৃণ্য এ লালসা তাদের মানবিক মূল্যবোধকে গলা টিপে হত্যা করেছে। তাদের প্রত্যক্ষ প্রচারণায় বিশ্বময় জন্ম নিয়েছে অপ্রত্যাশিত ধর্মহীনতা। এ ধর্মহীনতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে নাস্তিকতা। সমাজে নাস্তিক সংখ্যা ক্ষুদ্র হলেও প্রচলিত গণতন্ত্র তাদেরকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা ধর্মের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ধর্মবিহীন আস্তিক শাসকেরা। এ সুবিধা পেয়ে ক্ষুদ্র এ গোষ্ঠীটি বিশ্বময় ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছে। বিশেষত গোটা ইউরোপ থেকে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে হিজাবধারী নারী।

বিবিসির সূত্রে বলা হচ্ছে: ২০১৫ সাল থেকে ব্রিটেনে মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ শুরু হয়েছে। এ বিদ্বেষের মূল টার্গেট হলো হিজাবধারী নারী। একই সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে হিজাব পরিহিত এক ছাত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। ২০১৮ সালে স্কার্ফ পরা এক মুসলিম আইনজীবীকে ইতালির আদালত থেকে বের করে দেয়া হয়। ২০১৮ সালে অস্ট্রিয়ার সরকার ছাত্রীদের মাথায় স্কার্ফ পরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০১১ সালে ফ্রান্স সরকার মুসলিম নারীদের মুখ ঢাকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১৬ সালে ফ্রান্সের কান্স শহরের মেয়র ফরাসি মুসলিম নারীদের উপর সাঁতারের সময় শরীরে পরিধেয় বস্ত্র বুরকিনী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ২০১১ সালের জুলাই মাসে বেলজিয়াম সরকার মুসলিম নারীদের নেকাব ও বোরকা পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ আইন অমান্যকারীদের জন্য ১৩৭.৫ ইউরো জরিমানাও ধার্য করা হয়। এটা অনাদায়ের শাস্তি হিসেবে ৭ দিনের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় শরীর ঢাকা পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ আইন অমান্যকারীদের জন্য জরিমানা ধার্য করা হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে বুলগেরিয়াতেও একই আদেশ জারি করে। ২০১৭ সালে জার্মান সরকার দেশের ১৬ রাজ্যের ৮টিতে নারী শিক্ষকদের উপর হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডস সে দেশের সকল সরকারি অফিসে নেকাব ও বোরকা পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একই সালে নরওয়ের পার্লামেন্ট স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দেয়। ২০১৫ সালে রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট সেদেশের বিভিন্ন স্কুলে হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। হিজাব বিরোধী এ বিদ্বেষ এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজ্যক্ষমতা দখল করে। এসময় পর্যন্ত উপমহাদেশের সব ধর্মের রমনীগণ পর্দা পালন করতেন। বাংলা ও ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শাড়ি দিয়ে নারীরা তাদের শরীর আবৃত করে রাখত। ১৮০০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও কোনো অশালীন পোশাকের নজির পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমনকাল থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। প্রায় ২০০ বছরের শাসনামলে তাদের নির্লজ্জ সংস্কৃতি গোটা উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটে। মানুষের মাঝ থেকে লাজ-লজ্জা উঠে যেতে থাকে। এ নির্লজ্জ সংস্কৃতির সর্বশেষ নির্মম শিকার হলেন কর্নাটকের কলেজছাত্রী মুসকান খান। কর্নাটকের মান্ডা জেলার একটি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্রী মুসকান খান। অন্য দিনের ন্যায় তিনি একইভাবে হিজাব পরিধান করে কলেজে আসছিলেন। কিন্তু গেরুয়া রঙের স্কার্ফ পরিহিত একদল যুবক তার দিকে এগিয়ে আসে। তারা সংখ্যায় ছিল ৪০ জনের মতো। তাদের মুখে ছিল ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। স্লোগান দিয়ে তারা তার দিকে তেড়ে আসে। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘বোরকা ও হিজাব খুলে কলেজে যাও! আর যদি বোরকা পরে থাকতে চাও, তবে বাড়ি ফিরে যাও!’ একাকী তরুণী মুসকান তখন ভয় না পেয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর ধ্বনী দিতে থাকেন। এ ধ্বনিটি মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে পড়ে। এ তাকবীর ধ্বনি একদিকে হিজাব বিরোধীদের মুখে চপেটাঘাতের শামিল। অন্যদিকে ২০০ কোটি মুসলমানদের হারানো অধিকার ফিরে পাবার বার্তা।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন