আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ১৭৭৬ সালে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয় ‘‘All men are created equal with inalienable rights to life, liberty and the pursuit of happiness’’ অর্থাৎ জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান, আর তাদের রয়েছে জীবন ও স্বাধীনতা এবং সুখ অন্বেষণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আমেরিকার ইতিহাসে এটিই হল মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রথম উচ্চারণ। তবে আমেরিকার মূল সংবিধানে প্রকৃতপক্ষে বিল অব রাইটস তা অধিকার সংক্রান্ত বিল ছিল না। পরবর্তীতে ১৭৯১ সালে তাদের সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী গৃহিত হয় যেগুলো একত্রে ‘বিল অব রাইটার্স’ নামে পরিচিত। এতে যে সকল অধিকার সংযোজন করা হয়, সেগুলো হচ্ছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকার অভিযোগ প্রতিকারের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করার অধিকার, নিরপেক্ষ জুরির মাধ্যমে অনতিবিলম্বে ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকার। সম্পত্তির অধিকার, আইন উপদেষ্টা নিয়োগের অধিকার। নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয়ার অধিকার, একই অপরাধে দুইবার শাস্তি না পাবার অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, দাসপ্রথার বিলুপ্তি।
১৭৮৯ সালে French declaration of rights of man and of the citizen অর্থাৎ মানুষ ও নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত ফ্রান্সের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়। ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘোষিত মানবাধিকারের আলোকেই এটি প্রণীত হয়। ১৭৮৯ সালের এই ঘোষণা এবং ১৭৯১ সালের ফ্রান্সের রেনেসাঁ উত্তর প্রথম সংবিধানে যে সকল অধিকার প্রদান করা হয় সেগুলো হল, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি ইত্যাদি।
পাশ্চাত্যের আইন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের উপর আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, তাদের মানবাধিকারের ইতিহাস বড় জোর ১২১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ইতিহাস এবং এ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, স্বত:স্ফূর্তভাবে তারা মানুষের অধিকারসমূহকে স্বীকার করেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য শত শত বছরব্যাপী রক্ত ঝরাতে হয়েছে। আর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মানবাধিকারের সার্বজনীনতায় তারা বিশ্বাস করতেন না, আন্তরিক ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পাশ্চাত্যে মানবাধিকার সংক্রান্ত যে সকল দলিল আমরা পাই, সেগুলোর কোনটিই আন্তর্জাতিক তথা সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন ছিল না। বলা হয়ে থাকে, The charter of the United nations Organistion has internationalised the idea of human rights.’’ অর্থাৎ মানবাধিকারের ধারণাটির আন্তর্জাতিকরণ করেছে, জাতিসংঘ সনদ।’’ সকলেই এটি স্বীকার করেন যে, জাতিসংঘ যে, জাতিসংঘ সনদ (১৯৪৫)-এর আগে মানবাধিকারের ধারণাটি বিশ্বজনীন ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সার্বজনীন, বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ধারণা ইতোপূর্বে আসলেই কি কেউ দেননি, কোন আইন ব্যবস্থা তা কার্যকর করেনি এসব প্রশ্নের উপর আলোকপাত করার আগে আমরা আবার পাশ্চাত্যের মানবাধিকার আইনের উপর নজর দেব।
আজকের তথাকথিত সভ্যতার ধ্বজাধারী মানবাধিকারের স্বঘোষিত ধারক হিসেবে যারা আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আমরা দেখেছি যে, তারা মানবাধিকার সম্বন্ধে বুঝতে শিখেছে মাত্র সেদিন থেকে পাশ্চাত্য মানবাধিকারের বিকাশ পর্বে মানবাধিকারের রূপ কেমন ছিল এর উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ব্যক্তি মানুষের অধিকার (individual’s rights) এখনও স্বীকৃত হয়নি। ‘বিশেষ কারণে’ কিছু ব্যক্তি সমষ্টির অধিকার (rights of the groups of individuals) সম্বন্ধে পাশ্চাত্য সমাজের কন্ঠ উচ্চারিত হয়। অবশ্য তাদের এ মাথা ব্যথার কারণ ছিল ভিনদেশে তাদের নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা। কিন্তু তারাই নিজেদের দেশে অপর সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক নির্যাতন করত। নিম্নে এর উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হল ঃ
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে গোটা ইউরোপ ব্যাপী ধর্মীয় হানাহানি বিরাজ করে। এসব ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ বিরাজমান দেশসমূহে নিজ ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য প্রভাবশালী দেশগুলো সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। জার্মানীতে রোম ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় সমঅধিকার প্রদানের জন্য ১৬৪৮ সালে Peace of westphalla স্বাক্ষরিত হয় যার মাধ্যমে জার্মানীতে ৩০ বছরের ধর্মীয় হানাহানি শেষ হয়। এ শান্তিচুক্তি সম্পর্কে ড: এম, এরশাদুল বারী মন্তব্য করেন ঃ ‘‘The real motive was rather to promote favoured religious creeds than to promote religious freedom for all’’ অর্থাৎ উক্ত শান্তি চুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের পরিবর্তে পক্ষপাতমূলক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা।
কোন চুক্তির আওতায় কোন রাষ্ট্রের ভূখন্ডের অংশবিশেষ অপর রাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তরিত হলে নতুন রাষ্ট্রে তারা যেন ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা হত। উদাহরণ ১৭১৩ সালের নেদারল্যান্ড চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স হাডসন উপসাগর এবং আকাভিয়া গ্রেট ব্রিটেনের নিকট হস্তান্তর করে। উক্ত চুক্তির ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, সে এলাকার ক্যাথলিকরা এক বছরের মধ্যে ইচ্ছে করলে ফ্রান্সে চলে আসতে পারবে। আর যারা থেকে যাবে তাদেরকে গ্রেট ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এরা সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করত না, কেবল স্বধর্মের কেউ অপর কোন রাষ্ট্রে বৈষম্যের শিকার হল কিনা তা নিয়ে চিৎকার করত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন