॥ ছয় ॥
প্রিয়নবী (সা.) সকল ধর্মের মানুষকে পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। ধর্মের ব্যাপারে ইসলাম কারো প্রতি জবরদস্তি করে না। মদীনা নগররাষ্ট্রে কোন অমুসলমানের প্রতি ধর্মীয় ব্যাপারে জবরদস্তিমূলক আচরণ করা হয়েছে- এ ধরনের তথ্য প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে পারে। নবীজী (সা.) এদেরকে মুসলমানদের আমানত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলে করীম (সা.) তাঁর পবিত্র জীবনে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, তা হল, ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্ম-গোত্র-বর্ণ ইত্যাদি বিদ্বেষের কারণে কোন ব্যক্তির মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদা যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাবস্থান, চাকুরী লাভের অধিকার হরণ করা যায় না। নবীজী রাষ্ট্রে সকল মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন, সে রাষ্ট্রের কার্যক্রম চলত পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণকে মৌলিক অধিকার হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। এক্ষেত্রে আল্লাহর ফরমান তিনি পেশ করেন ঃ “যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামায কায়েম করে, পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করেন ‘‘এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’’ নবীজী তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে শিক্ষার অধিকার প্রদান করেছেন বললে বোধ হয় ঠিক বলা হবে না, বরং তিনি শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করে মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি অনতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মানব ইতিহাসে মানবদরদী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দাস-দাসীদেরকে পূর্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার প্রদান করেন। তিনি দাসপ্রথাকে সমূলে উচ্ছেদ করেন। খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর শুভ বিবাহের সময় আরবের তৎকালীন ঐতিহ্য অনুযায়ী যায়েদকে দাস হিসেবে প্রদান করা হয়। কিন্তু নবীজী (সা.) তাঁকে মুক্ত করে দেন। অবশ্য রাসূলে করীম (সা.)-এর সাহচর্য ছেড়ে যায়েদ তাঁর নিজের পিতার সঙ্গে যেতে না চাইলে সারাজীবন নবীজী (সা.) তাকে এমন মর্যাদার আসনে রাখেন যে, সকলে যায়েদ (রা.)কে নবীজীর ছেলে মনে করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাহতদের প্রতি এত চমৎকার ব্যবহার করতেন যার দৃষ্টান্ত পাশ্চাত্য সমাজে আজও কল্পনা করা যায় না। যুদ্ধবন্দীদের তিনি শিক্ষিত ও অশিক্ষিত এ দু’ভাগে ভাগ করে শিক্ষিতদের দায়িত্ব দিতেন অশিক্ষিত মুসলমানদের পড়ানোর এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক মুসলমানকে জ্ঞানের আলো বিতরণের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করে দিতেন। আর অশিক্ষিতদেরকে সামান্য কিছুর বিনিময়ে মুক্ত করে দিতেন। যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে এত চমৎকার মানবিক ব্যবহার পৃথিবী কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। নারীদেরকে তিনি সর্বাঙ্গীণ সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীদেরকে তিনি পুরুষদের সঙ্গে কেবল সমঅধিকার নয়, বরং মান-মর্যাদার দিক থেকে তাদেরকে পুরুষদের উপরে স্থান দেন। নারীদেরকে তিনি সকল অধিকার প্রদান করেন যার মধ্যে মোহরের অধিকার, ভরণ-পোষণের অধিকার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
অধিকার শুধু প্রদান করলেই হয় না; বরং তা বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। অধিকার প্রদান করে তার বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। অধিকার প্রদান করে তার বাস্তবায়ন না করা মারাত্মক প্রতারণার শামিল। নবী করীম (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সকল প্রয়োজনীয় অধিকার শুধু প্রদান করেননি, বরং সবকটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করেন। উপরন্তু, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে যে, যদি কোন ব্যক্তি অপরের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং অন্যের অধিকার হরণ করে তাহলে পরকালে তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ইসলামে যে সকল মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে এগুলো পূর্ণাঙ্গ, সার্বজনীন, শাশ্বত ও চিরন্তন। সুতরাং ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকারের ধারণার আন্তর্জাতিকীকরণ করেছে এ বক্তব্য সত্যে অপলাপ বৈ কিছু নয়। তাছাড়া ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রণীত সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র মানবাধিকারকে সার্বজনীন করেছে এ ধরনের বক্তব্যও ডাহা মিথ্যা। মানবাধিকারের পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছে ইসলাম, মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেছে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন