জাতিসংঘ সদর দফতরে ‘কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের (সিএসডব্লিউ) ৬১তম সেশনে কান্ট্রি স্টেটমেন্ট পর্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব ও নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে তাঁর সাফল্যগাঁথার চিত্র তুলে ধরেন। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন, কর্মজীবী মায়েদের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন, দুঃস্থ নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তৃণমূলে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত নানা উদ্যোগ এবং গত ক’বছরে ১ লক্ষ ৭০ হাজার নারীর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের কথা বলেন। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইউএন উইমেনের প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়নশীপ অ্যাওয়ার্ড ও গ্লোবাল পার্টনার ফোরামের ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির কথাও তিনি সকলকে মনে করিয়ে দেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এমডিজির অর্জিত সাফল্য বাংলাদেশকে ২০৩০ এর আগেই এসডিজি ৫-এর লিঙ্গ সমতা বাস্তবায়নে সাহায্য করবে।
আমরা নারী উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি সাফল্যকে অভিনন্দিত করি। কিন্তু এ উন্নয়নের সুফল যারা ভোগ করবে তারা যদি স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দময় জীবনের অধিকার বঞ্চিত হয়, ঘরে-ঘরে পদে-পদে যদি নির্যাতনআতঙ্ক তাদের বিড়ম্বিত জীবনের কারণ হয়, কী হবে এই উন্নয়ন দিয়ে? একটি মাত্র জীবন আমাদের! সবকিছু এ-জীবনের জন্যই তো!
ধর্ষণকে পতিতাবৃত্তির সমবয়সী এক সামাজিক সমস্যা বলা যায়। ধর্ষণ একালে এসে সংঘবব্ধ ধর্ষণে রূপ নিয়েছে এবং পরিকল্পিত নানা ঘটনার মতো ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। জন্মদিনের বা অন্য কোনো উপলক্ষের বাতাবরণে ধর্ষণের ঘটনা আমরা দেখেছি। বিয়ে বাড়িতে বন্ধুর বোন বা প্রেমিকাকে বন্ধবীসহ দাওয়াত দেওয়া হয়। শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে তাদের ঘুমের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় পরিকল্পিত স্থানে। তারপর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের খবর অহরহ আসছে পত্র-পত্রিকায়।
বর্ষবরণের দিনে পড়ন্ত বেলায় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল কিছু যুবতী মেয়ে। এ ঘটনার পর পর জার্মানির কোলন শহরে ঐতিহ্যবাহী কার্নিভালের সংবাদ সিএনএনের সহযোগী একটি টিভি চ্যানেলের পক্ষে সরাসরি প্রচার কার্যের দায়িত্বে থাকা এক নারী সাংবাদিককে যৌন হয়রানি করতে দেখেছেন দর্শকেরা। দুদিক থেকে দুজন নির্যাতনকারীর আচরণে বিব্রত, বিক্ষুব্ধ, দুঃখী ও অসহায় সে নারী সাংবাদিকের ছবি দেখে সবাই স্তম্ভিত। বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরা ভেবেছি আমরা তবে কোন ছাড়? কার্নিভাল উৎসবের সেই ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে, ভাষ্য সে দেশের পুলিশের। ভন্ড-পীর-ফকির-পুরোহিতের আস্তানায় দিনের পর দিন নির্যাতিত হচ্ছে কিশোরী-তরুণীরা। পিতা-মাতার অসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস এক্ষেত্রে কিশোরীদের নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েই চলে। কেরালার পেট্টা এলাকায় শয্যাগত স্বামীর জন্য মেয়ের উপর পূজার ভার দিয়ে মা ব্যস্ত ছিলেন সংসার চালাতে। দিনের পর দিন ভন্ড সাধুর নির্যাতনে অতিষ্ট মেয়েটি সুযোগ বুঝে ধারালো ছুরিতে সাধুর লিঙ্গ কর্তন করে। তরুণীর এই সাহসিকতাকে সমর্থন করেছে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। পুলিশের পক্ষ থেকে সেখানে মামলা হয়েছে সাধুর বিরুদ্ধে, তরুণীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি। আমরা নির্যাতিতার প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধুবাদ জানাই।
বর্তমানে নারী নির্যাতনের নতুন নতুন পথ আবিষ্কৃত হচ্ছে। সাইবার অপরাধের লক্ষ্য মূলত নারী। নারীর গোপনীয়তা হরণের নগ্ন উৎসব চালানো হয় এর মাধ্যমে। পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহতার ঘটনাও প্রচুর ঘটে চলেছে আমাদের শহরে-গ্রামে সর্বত্র। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব নারীই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের কথা আমরা ভুলিনি। নির্যাতক প্রেমিক বা স্বামী কত পাষন্ড হতে পারে এদেশের শত হাজার লক্ষ কোটি নারীকে তা দেখে যেতে হয়, সয়ে যেতে হয়। তালাক দিয়েও রেহাই মেলে না অনেকের। মুগদাপাড়ার তালাকপ্রাপ্ত আকলিমাকে ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত করেছে তাঁর প্রাক্তন স্বামী।
নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন চাই। এই লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলনের কথা সবাই বলেছেন। পাশাপাশি নির্যাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। চাই যে আইনের কাছে পৌঁছানোর পথটি নারীর জন্য সহজ হোক। হেল্পলাইনটি সহজলভ্য ও কার্যকর হোক। কয়েক বছর ধরে চলা কিছু ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত আসামির সংখ্যাও কম নয়। তবু আমরা চাই ঘটনাসহ আসামীর নামÑধাম ছবিসহ এসব রায়ের বিস্তারিত বিবরণ আসুক সংবাদে, সংবাদপত্রে বিশেষ করে। সেই সঙ্গে নারীর নিজস্ব সচেতনতা, সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। হ্যাঁ বিয়ের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিয়ের প্রলোভন যে আদৌ প্রলোভনের কোনও বিষয় নয়, নারীকে তা বুঝতে হবে।
ভাসিনের কথা শুনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘের নারী বিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত কমলার সঙ্গে একবেলা শীর্ষক একটি বক্তৃতায় (২০ মে ২০১৭) এবং বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি নারী বিষয়ক নানা কথার জবাব দেন। তিনি বলেন, আমরা এ মুহূর্তে পোস্ট ফেমিনিজম পর্যায়ে রয়েছি। নারীর সমতা প্রতিষ্ঠায় এখন ‘হি ফর শী’ নয় ‘হি’ই হবে সহায়ক। পুরুষ পুরুষকে সচেতন করলে নারীবাদের স্বপ্ন এগিয়ে যাবে এবং এতে লাভবান হবে পুরুষ নিজে। কমলা বলেন, এখনও ৯০ শতাংশ সম্পদ, পেশা, সমাজের নিয়ন্ত্রণ সবই পুরুষের হাতে। পেরেছে কোনও নারী পোপ হতে? ঔপনিবেশিক পিতৃ-তান্ত্রিকতা সবেগে বহমান এখনও। শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্যই সকল বৈষম্যের হেতু, আজও। তিনি দেখিয়ে দেন যে ঘরে তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন সেখানে সমবেত নারীরা সকলেই উচ্চ শ্রেণির ও শিক্ষিত। কিন্তু এটি যেমন প্রকৃত চিত্র নয়, তেমনি নারী জনসংখ্যার অর্ধেক বটে তবে সংসদ তারও ৯০ শতাংশ পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন নারী-পুরুষ উভয়েরই। বাংলাদেশের নারীদের উপর চলমান সহিংসতা ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন তিনি। তাঁর অবস্থানকালীন সময়ের ওই স্বল্প সময়ে তিনটি ধর্ষণ ঘটনার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, ধর্ষক হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, আমরা সবাই মিলে ওদের ধর্ষক বানিয়েছি। প্রতিটি ধর্ষণ ঘটনার এবং ধর্ষকের বিচার চান তিনি। পুরুষতন্ত্রকে কুসংস্কার বলে অভিহিত করেন তিনি। নারীর চুল থেকে পা পর্যন্ত পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। তারা নারীকে স্বাধীনতা দিতে চায় না কারণ স্বাধীন হলে নারী তাদের শোষণের আওতার বাইরে চলে যাবে। তারা যেহেতু নারীকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী রাখতে চায় সেহেতু নারীর বাইরে বেরুতে হবে। বলতে হবে আমি বাইরে যাবো।
কমলা ভাসিনের সব কথা আমরা মানি না। তিনি যখন বলেন ঘর থেকে বেরুলেই নারীর উপর সহিংসতা কমবে সুতরাং বেরিয়ে পড় নারী। যখন যেখানে খুশি, যেভাবে খুশি। আমরা এটা চাইব না।
আমরা নারী নির্যাতনের ক্রমভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা রূপ দেখে নিজেদের মধ্যে কুঁকড়ে যাচ্ছি। নারী-শিশু পাচার ও দেহব্যবসার কাজে তাদের বাধ্য করার গল্প আমাদের দেশেও প্রচুর হয়েছে। নেপালেও এদের রমরমা ব্যবসার খবর নতুন নয়। জানা যায়, পাচারকৃত নেপালি নারীদের অজ্ঞান করে গায়ের চামড়া নাকি খুলে নেওয়া হচ্ছে। এই চামড়া ল্যাবে প্রক্রিয়াজাতকরণের পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের নানা দেশে যাচ্ছে। কসমেটিক সার্জারির কাজে ব্যবহৃত ও চামড়া প্রতি ২০ বর্গ ইঞ্চি ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের খবর আমরা শুনতে চাই না। আমরা নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার অবসান চাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন