রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে মশার উপদ্রব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, নগরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রাজধানীতে সাম্প্রতিককালে কিউলেক্স মশার বংশ বিস্তার ও ঘনত্ব অতিমাত্রায় ছাড়িয়ে গিয়েছে। এক জরিপে দেখানো হয়েছে, রাজধানীর জলাশয়গুলোতে মশার ঘনত্ব ৬০ ভাগ। মশার ধরণ অনুযায়ী, ৮০ ভাগই হচ্ছে কিউলেক্স প্রজাতির। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই এমনকি দিনের বেলায়ও মশার যন্ত্রণায় নগরবাসী স্বস্তি পাচ্ছে না। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বাজার, উন্মুক্ত স্থান, পার্ক, সড়ক, যানবাহনে মশার উপদ্রবে মানুষ নাজেহাল হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটছে। কেউ কেউ মশারি টানিয়ে পড়াশোনা করছে। কয়েল, অ্যারোসল জাতীয় স্প্রে দিয়েও মশার আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কীটতত্ত¡বিদদের মতে, শীতের মধ্যে নর্দমা, জলাশয় ও আবর্জনা পরিস্কার না করায় মশার এই ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটছে। দিনের তাপমাত্রা হঠাৎ ৩২-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ায় নর্দমা ও জলাশয়ের জমে থাকা পানির ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তা মশার বংশ বিস্তারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মশা নিয়ন্ত্রণে বরাবরই দুই সিটি করপোরেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও জনবল থাকলেও মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
রাজধানীর বায়ুদূষণ, শব্দদূষণসহ পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয়। এসব দূষণের শিকার হয়ে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশের মারাত্মক দূষণের কারণে রাজধানীবাসীর গড় আয়ু ৩ বছর কমছে। এছাড়া ক্যান্সার, হৃদরোগ, হাঁপানি, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ¯œায়ুবিক রোগের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে তারা আক্রান্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই দূষণের মধ্যেই নানা উপদ্রবের দেখা দেয়। এর মধ্যে মশার উপদ্রবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। অনেকে এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। এর দায় এক অর্থে দুই সিটি করপোরেশনের ওপর বর্তায়। মশা নিধনে তাদের ব্যর্থতার কারণেই মানুষকে মশার উপদ্রব ও রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, করোনা মহামারি এমনিতেই মানুষের কাছে আতঙ্ক হয়ে রয়েছে, এর মধ্যে মশার কামড়ে ডেঙ্গু হানা দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। অথচ প্রতিবছরই মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ৮৫ কোটি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এত বরাদ্দ এবং জনবল থাকা সত্তে¡ও মশা নিধনের দুই সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হচ্ছে। মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তাতে কোনো কাজ হয় না। কোনো রকমে ওষুধ ছিটিয়ে দায় সারা হচ্ছে। কীটতত্ত¡বিদরা মনে করছেন, সিটি করপোরেশনের এভাবে ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিধন করা যাবে না। এর মূলে যেতে হবে। মশার যে লার্ভা থাকে, তা ধ্বংস করতে হবে। এসব লার্ভা রাজধানীর ৭৫০ কিলোমিটার জুড়ে বক্সকালভার্ট ও কভার্ড ড্রেনে থাকে। দুই সিটি করপোরেশন এসব লার্ভা ধ্বংসে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে সেখান থেকেই মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশনের এই ব্যর্থতার কারণে মশার কয়েল, স্প্রে ও মশারি বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, এসব পণ্যের বিক্রি বৃদ্ধি করার জন্য মশার নিয়ন্ত্রণ না করে কৌশলে উদ্রব বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এ অভিযোগ অতীতেও উঠেছিল। এতে সংশ্লিষ্ট পণ্যের প্রতিষ্ঠানের সাথে দুই সিটি করপোরেশনের অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার আহŸান জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। মশা নিধন কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা সত্তে¡ও এবং ওষুধে কাজ না হওয়া নিয়ে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভিাগের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের প্রতি বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট এবং অকার্যকর ও নি¤œমানের ওষুধ ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মশা নিধনের ব্যর্থতার জন্য দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগই দায়ী।
কীটতত্ত¡বিদরা গত মাসেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, মার্চ মাসে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। মশার বংশ বিস্তার ও উপদ্রব যাতে না বাড়ে, এ ব্যাপারে আগে থেকেই দুই সিটি করপোরেশনের ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া উচিৎ ছিল। ড্রেন, নর্দমা, বক্সকালভার্ট ও ঢাকনা দেয়া যেসব ড্রেন রয়েছে সেখানে জমে থাকা ময়লা পানি পরিস্কার করে মশার প্রজনন রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যেত। এ কাজ করতে দুই সিটি করপোরেশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীর পরিবেশ দূষণ রোধেও তাদের তেমন গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেই। ফলে দূষণ ও মশার উপদ্রবে নগরবাসীর যাপিতজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগের কথা মুখে মুখে বললেও তা বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তা নাহলে, মশার উদ্রব বাড়বে কেন? আমরা মনে করি, দুই সিটি করপোরেশনকে অবিলম্বে মশা নিধনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যে ধরনের পদক্ষেপ নিলে মশা নির্মূল হবে, তার সব উদ্যোগ নিতে হবে। কীটতত্ত¡বিধদের সাথে পরামর্শ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নগরবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে মুক্ত করে স্বস্তি দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন