শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারাদেশ। প্রশাসনের উদাসীনতায় পলিথিন ব্যবসায়ীদের এখন পোয়াবারো। নিষিদ্ধ ব্যবসা করে অনেকেরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেক করে পলিথিনের ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতারা হয়েছেন কোটিপতি। পলিথিনে সারাদেশের পরিবেশ বিপর্যস্ত, ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল-বিল, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ। অনুসন্ধানে জানা গেছে পুরান ঢাকার নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানার সংখ্যা দু’শ থেকে বেড়ে এখন তিনশ’ ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক গুণ লাভ হয় বলে প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকেছে পলিথিনের দিকে। নিষিদ্ধ বলে পুরান ঢাকায় পলিথিনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে টিকিয়ে রাখা হয়েছে এই ব্যবসা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা টাকার জোরে অনেক শক্তিশালী। তারা প্রয়োজনে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। গত রোববার দুপুরে পুরান ঢাকার চকবাজারে অবৈধ পলিথিন নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে হামলার শিকার হন যমুনা টিভির দুই সাংবাদিক। সন্ত্রাসীরা তাদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় অল্পের জন্য রক্ষা পান তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে এখন নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা। আগে এই কারখানার সংখ্যা দু’শ মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সারাদেশে পলিথিনের বিস্তারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পলিথিনের কারখানা দিন দিন বাড়ছে। এখন কারখানার সংখ্যা তিনশ’ ছাড়িয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, কামালবাগ, ইসলামবাগ, দেবিদাসঘাট, শহীদনগর, খাজেদেওয়ান, কিল্লার মোড়, বেগমবাজার, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, ছোটকাটারা, বড়কাটারা, মৌলভীবাজার, রহমতগঞ্জ, মিটফোর্ড, ফরিদাবাদ, ইমামগঞ্জেই রয়েছে আড়াইশ’ পলিথিন কারখানা। এ ছাড়া কাওরানবাজার, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, তেজগাঁও এলাকাতে রয়েছে পলিথিন কারখানা। সূত্র জানায়, গার্মেন্ট, লবণ ও চিনিসহ ২৩ প্রকার প্যাকেজিং ও মোটা পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে শত শত কারখানায় তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিত্যক্ত বিষাক্ত পলিথিন সামগ্রী। গ্যাস্ট্রিক, মিকশ্চার, পরিপ্রোফাইল, পলিইথাইল, এইচডিপিসহ বিভিন্ন নামে এসব পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে গাজীপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের ৩০টি জেলায় এখন পলিথিন তৈরি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চকবাজার থানার অদূরেই বেগমবাজার, মৌলভীবাজার ও চকবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানার প্রকাশ্যে পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এসব পলিথিন চকবাজারের পাইকারি দোকানসহ বিভিন্ন দোকানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়। জানতে চাইলে চকবাজারের একজন পাইকারি দোকানদার জানান, পলিথিন কারখানাগুলো এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে। সে কারণে পরিথিন বিক্রিতে কোনো গোপনীয়তার প্রয়োজন হয় না। ওই দোকানদার বলেন, চকবাজারের কোনো কারখানাই আগে পলিথিনের কারখানা বলে পরিচয় দিতো না। বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক ও পলিব্যাগের নমুনা রাখা হতো পাইকারি দোকানের সামনে। ক্রেতা আসার পর অর্ডার দিলে গোডাউন থেকে পলিথিন প্যাকেট করা হতো। এখন তো এসব দেখা যায় না। এখন সবকিছুই প্রকাশ্যেই চলে। খুচরা বাজারের দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে একইরকম তথ্য। আগে বাজারগুলোতে পলিথিন ব্যাগে কোনো জিনিস দিতে গেলে দোকানদাররা এদিক-ওদিক দেখে নিতেন। এখন আর তার কোনো প্রয়োজন হয় না। যাত্রাবাড়ী বাজারের এক দোকানদার বলেন, পলিথিন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কোনো ঝামেলা নেই। পাইকারী-খুচরা সবই পাওয়া যায় বাজারের দোকানগুলোতেই। ক্রেতারাও পলিথিনে জিনিস নিতে কোনো দ্বিধা করেন না। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন মাছ, গোশত থেকে শুরু করে চাল, ডাল তেল, লবণ, সাবান সবকিছু বহন করা হচ্ছে পলিথিনে। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার তিন শতাধিক কারখানায় তৈরি পলিথিন সারাদেশেই সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি কারখানা থেকে পলিথিন রাতে ইমামগঞ্জ আসে। সেখান থেকে মধুপুর ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এই মধুপুর ট্রান্সপোর্টের মালিকও পলিথিন সিন্ডিকেটের সদস্য। সূত্র জানায়, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ইমামগঞ্জে মধুপুর ট্রান্সপোর্টের কাভার্ডভ্যান সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর সেগুলোতে পলিথিনের বস্তা ভরা শুরু হয়। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। এরপর একে একে সেগুলো ছেড়ে যায়। রাতে কোনো কোনো সময় কাভার্ঢভ্যানে মাল তোলার সময় পুলিশও উপস্থিত থাকে। ইমামগঞ্জ থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০টি কাভার্ডভ্যান ছাড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন নিয়ে। অথচ প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর খবর রাখেন না। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে সারাদেশেই আমাদের অভিযান চলছে। পলিথিন কারখানা সিলগালা করা হচ্ছে। দোষীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও ঢাকায় এসএ পরিবহনের পলিথিন বোঝাই কয়েকটি গাড়ি আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় এস পরিবহনের ম্যানেজারকেও গ্রেফতার করা হয়। গত রোববার চকবাজারে পলিথিনের উপর প্রতিবেদন তৈরী করতে গিয়ে যমুনা টিভির দুই সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছে জানিয়ে পরিবেশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছে।
এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। ওই হিসাবে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতিমাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪১ কোটি পিস। প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। এতে ড্রেন-নালা, খাল ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে রাস্তা উপর দিয়ে ময়লা আবর্জনা প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এটা মহামারি আকারে দেখা দিলে রাজধানীবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, অতি সূক্ষ্ম ইথিনিল পলিমার পলিথিন তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়, যা অপচনশীল। এতে করে জমির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়। এ ছাড়া পলিথিনে বহন করা যে কোনো ধরণের খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘক্ষণ থাকলে বিষক্রিয়ায় তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একই সাথে পলিথিনে রাখা খাবার খেলে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারেরও ঝুঁকি থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ এন এম ফখরুদ্দিন বলেন, পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে সুয়ারেজ লাইন বন্ধ হযে যাবে, নদী মরে যাবে, প্রাণীজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের জন্য সময়োপযোগী আইন করার উপর গুরুত্বারোপ করে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এ এন এম ফখরুদ্দিন বলেন, এখনও সময় আছে পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষার জন্য ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ হয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন