বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যাত্রাপথ নিরাপদ করতে হবে

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২২, ১২:০৪ এএম

একটি দুর্ঘটনা মানে সারাজীবনের জন্য কান্না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে দুর্ঘটনা হচ্ছে। স্থলপথে কখনো সড়ক দুর্ঘটনা, নদীপথে কখনো লঞ্চ দুর্ঘটনা, রেলপথে কখনো ট্রেন দুর্ঘটনা আবার আকাশপথে কখনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে অনেক মানুষ। সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেকে। বহু পরিবার চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা ফুলের মতো সাজানো সংসার মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সারাজীবনের স্বপ্ন মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই সারাজীবনের জন্য এতিম হয়ে যাচ্ছে। একটি দুর্ঘটনা মানে স্বজন হারানোর মর্মস্পর্শী বেদনা। স্বজনহারা মানুষদের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে আর মানবতা হাহাকার করে। অথচ, আমাদের একটু সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা এসব দুর্ঘটনা অনেকাংশেই বন্ধ করতে পারে এবং বাঁচাতে পারে হাজারো মানুষের জীবন।

দুর্ঘটনায় যাদের জীবন হারিয়ে গেছে তাদের আমরা কিছুতেই আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু ভবিষ্যতে দুর্ঘটনায় আর কোনো মানুষ যেন হারিয়ে না যায় এবং পঙ্গুত্ব বরণ না করে তা নিশ্চিত করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা প্রত্যেকেই যদি এসব দুর্ঘটনা রোধে এগিয়ে আসি এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করি তাহলে এই ভয়াবহ বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। যানবাহানের দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে এবং যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো বেঁচে আছে, তারা সবাই আমার আপনার মতই মানুষ। তারা প্রত্যেকেই আমাদের কারো না কারো পিতামাতা, কারো না কারো ভাইবোন অথবা কারো না কারো আত্মীয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট এলাকায় একটি পিকাপের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মারা যান আপন ছয় ভাই। উপজেলার হাসিনাপাড়া গ্রামের এসব লোক ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করা পিতা সুরেশ চন্দ্র সুশীলের মৃত্যু পরবর্তী ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। তারা এ সময় রাস্তা পারাপারের জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় কক্সবাজার অভিমুখী একটি পিকাপ হঠাৎ করে তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চ¤পক সুশীল (৩০) এবং স্মরন সুশীল (২৯) নামের আপন পাঁচ ভাই। আর হাসপাতালে ১৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান অপর ভাই রক্তিম সুশীল (৩২)। এভাবে এই ঘটনায় একটি পরিবারের আপন ছয় ভাইয়ের মৃত্যু হলো। সুরেশ চন্দ্র সুশীল এবং মানু রাণু সুশীল দ¤পতির ৮ ছেলে ২ মেয়ে। তম্মধ্যে ২ বছর আগে অসুস্থ হয়ে বড় ছেলে মারা যায়। এখন এক দুর্ঘটনায় মারা গেল ৬ ছেলে। বেঁচে আছে একমাত্র ছোট ছেলে ও দুটি মেয়ে। তাদের মা মানু রানী সুশীল ছয়টি ছেলেকে একসাথে হারিয়ে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। জীবন আছে বলেই তিনি বেঁচে আছেন। এই দুর্ঘটনার কারণে ছয়টি পরিবার মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে গেল, ছয় ভাইয়ের ছয় স্ত্রী অল্প বয়সেই বিধবা হলো এবং তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শিশু কালেই এতিম হয়ে গেল। এদেরকে সান্ত¦না দেয়ার ভাষাও নেই।

২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাটি জেলার সুগন্ধা নদীতে রাত্রিবেলা একটি লঞ্চে আগুন লাগলে আগুনে পুড়ে মারা যায় ৪০ জনের বেশি মানুষ। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ১১টায় ভোলার লালমোহন উপজেলার তেতুুলিয়া নদীর নাজিরপুর ঘাটে লঞ্চ ডুবে শতাধিক মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আবু তোরাব গ্রামে স্কুল ছাত্রদের বহনকারী একটি ট্রাক উল্টে খাদে পড়ে গেলে পানিতে ডুবে মারা যায় ৬০ জন স্কুল ছাত্র। এসব ছাত্র স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে বিজয়ী হয়ে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরছিল। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের কাঠমুন্ডু বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং এতে ৫১ জন মানুষ মারা যায়। এবার নিজের স্বচক্ষে দেখা একটি দুর্ঘটনার কথা বলছি। ২০০৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছিলাম। চকরিয়ার পরে গার্মেন্ট কর্মীদের একটি বাস আমাদের গাড়িটাকে ওভারটেক করল। আবারো ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা মাইক্রোবাসকে সাইড দিতে গিয়ে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং রাস্তার পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে যায়। বাসটির ধাক্কায় খুঁটিটি ভেঙ্গে বৈদ্যুতিক তারসহ বাসটির ওপর পড়ে। বাসটি উল্টে না যাওয়ায় এবং এ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় অধিকাংশ যাত্রী সুস্থভাবে নেমে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরক্ষণেই বিদ্যুৎ চলে আসায় পুরো গাড়িটা বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় এবং গাড়ির ভিতরে থাকা ১৪ জন যাত্রী বিদ্যুতায়িত হয়ে মুহূর্তেই মারা যায়। অথচ, ওভারটেক না করলে এই ধরনের হৃদয়বিদায়ক এবং মর্মান্তিক ঘটনাকে রোধ করা যেত এবং কোনো প্রাণহানি হতো না। এভাবেই প্রতিনয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে এবং এতে অসংখ্য মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং যাত্রাপথকে নিরাপদ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আরম্ভ করে বেসরকারি পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায় থেকে আরম্ভ করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থাৎ প্রত্যেককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে এবং সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ওভারটেক নিষিদ্ধ করতে হবে। যেনতেনভাবে ওভারটেক করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। কোনো ধরনের অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে দেয়া যাবে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনো ড্রাইভার যেন গাড়ি চালাতে না পারে তার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। মদ পান করে এবং ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানো যাবে না। উপযুক্ত ফিটনেস ছাড়া কোনো গাড়িকে চলাচলের অনুমতি দেয়া যাবে না। গাড়িতে উঠলেই আমরা কেবল আগে যেতে চাই। প্রায় শুনি চালক নিয়ন্ত্রণ হারানোতে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। কিন্তু পরিমিত গতিতে গাড়ি চালালে তো নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা নয়। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালালেই চালক কেবল নিয়ন্ত্রণ হারায়। তাই অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো পরিহার করতেই হবে। গাড়ি চালানোর আগে ড্রাইভারদের উচিত পর্যাপ্ত সময় বিশ্রাম নেয়া। কারণ, সুস্থতা ছাড়া একজন ড্রাইভারের পক্ষে নিরাপদে গাড়ি চালানো কখনো সম্ভব নয়।

লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন