শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিশুর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

মো. হাবিবুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২২, ১২:৩০ এএম

প্রতিটি শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ যত্নের দাবিদার। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে নানা কারণে এর ব্যত্যয় ঘটছে। আদর-ত্নে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ প্রভাবে অনেক শিশু প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। ছোট ছোট ভুল করতে করতে একসময় তারা এমন সব কর্মকা-ে জড়িয়ে যাচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা, বিশেষ করে, যারা শহরাঞ্চলে থাকে, তারা মাঠে বা বাইরের খেলাধুলার চাইতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিশেষজ্ঞরা ১৮ বছরের আগে কোনো শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এ পরামর্শের প্রতি আমাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের আবদার রক্ষার্থে তাদের দামী ও সুন্দর স্মার্টফোন এবং মটর সাইকেল কিনে দিচ্ছেন।

শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘শিশু আইন, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শিশু আইন যুগোপযোগী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী শিশুদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। অভিযুক্ত শিশুদের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোতে বিচারাধীন। শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো নির্দেশনা রয়েছে। জেলা সমাজসেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত শিশুকে নিয়ে আইনের আলোকে দায়িত্ব পালন করেন। অভিযুক্ত শিশুদের কাজ করার জন্য অনেকগুলো সেফ হোম ও কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। অভিযুক্ত শিশুরা মূলত জামিনের পূর্ব পর্যন্ত ওই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করে। অভিযুক্ত শিশুদের মানসিক উন্নয়ন এবং অপরাধ থেকে ফেরাতে এ কেন্দ্রগুলোতে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে এ জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এমন একটি বাক্য, যার বিপরীতে আমাদের করণীয় কী, একথা আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয়গুলো এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত। আমাদের অনেকেরই ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতাও কম। তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ অল্প। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো তুলনামুলক কম লাগে বলে, তাদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলক ছোট। আর এই মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে আমাদের তেমন কোনো জবাবদিহিতা নেই। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়।

আমরা জানি, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের বেশি শিশু। তার মধ্যে অনেক শিশুর পরিবার খুবই দরিদ্র। এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্মী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিয়ের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। সুতরাং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এ সকল প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেননা, এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য এ লক্ষ্য নিয়ে বিশেষভাবে এসব শিশুদের জন্য কাজ করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করেছে। কিন্তু এই সুপারিশ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এটা প্রতিকারে আইনি অনেক বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকা- প্রতিরোধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করে দিয়ে এই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিবার, স্কুল, মিডিয়া এবং সামাজিক সংগঠনগুলো শিশু সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক কর্মক- ও ইতিবাচক চর্চাগুলো নিশ্চিত করে। শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশে সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামো গঠন এখন সময়ের দাবি।

সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামোর মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো বাজেটে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা। বাংলাদেশে এখন শিশুদের জন্য ‘শিশু বাজেট’ নামে যে চর্চাটি রয়েছে, তা শিশুদের চাহিদা পূরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা, এই শিশু বাজেট মূলত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি সামগ্রিক চিত্র মাত্র। এতে করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও বাজেট করা হয় না। তাই এই বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় শিশু এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের নানা বিষয়ে আইনের আরো কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও অধিকতর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন