জলবায়ু পরিবর্তনজণিত বিপর্যয় বর্তমানে তা অন্যতম বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম ভালনারেবল কান্ট্রি হিসেবে চিহ্নিত। জলবায়ু ও পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিশ্ব নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি নদী ও পরিবেশ দূষণে জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। একদিকে উজানে আন্তর্জাতিক নদীর উপর ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের নদ-নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, অন্যদিকে নদীব্যবস্থাপনা, শিল্পকারখানা ও নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সীমাহীন ব্যর্থতা এবং নদনদী, খালবিল ও জলাভূমির উপর প্রভাবশালী মহলের অব্যাহত দখলবাজি, ভরাট ও দূষণের কারণে নদনদীগুলো বায়োলজিক্যালি মৃত্যুর মুখে পড়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ চারপাশের নদনদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, চাকতাই খালসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরের লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত নদনদীগুলো এখন চরমমাত্রার দূষণ ও নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্বের হুমকিতে পড়েছে। এসব নদনদীর নাব্যতা রক্ষা, দূষণ ও দখল প্রতিরোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে শহরের বাসযোগ্যতা ও পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে ঘিরে থাকা তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ, দখল-ভরাট ও উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লাইফলাইন কর্ণফুলী নদীর ভয়াবহ দূষণের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান আন্ত:সীমান্ত নদী কর্ণফুলী শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের কৃষি, বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও লৌকিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে আছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অপরিকল্পিত ও ক্রমবর্ধমান হারে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ণ, নগরায়ণ ও বাণিজ্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় কর্ণফূলী এখন মারাত্মক দূষণের শিকার। বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীর দূষণ এমন স্তরে পৌছেছে যে, এদেরকে এখন নদী না বলে তরল বর্জ্যরে ভাগাড় বললেও অত্যুক্তি হয়না। লুসাই পাহাড়ের অজস্র ঝরনা ও ছরার পানির সম্মিলিত প্রশ্রবণ থেকে উৎপন্ন মিঠা পানির বিশাল ভান্ডার কর্ণফুলী প্রায় ৩২০ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। হাজার বছর ধরে এ নদী কোটি মানুষের সুপেয় পানি, কৃষি ও মৎস্যের অন্যতম ভান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে এসেছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের অপরিনামদর্শী অপতৎপরতা ও ব্যর্থতার কারণে কর্ণফুলী ও বুড়িগঙ্গার মত গুরুত্বপূর্ণ নদী এখন বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত নহরে পরিনত হয়েছে। ছোট-বড় হাজার হাজার কলকারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ও প্রতিদিনের নাগরিক বর্জ্যে কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানির গুনাগুণ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য, জলজপ্রাণীর বেঁচে থাকার ন্যুনতম যোগ্যতাও।
আন্ত:সীমান্ত নদীসহ দেশের বেশিরভাগ নদীতে এখন বড় বড় চর জেগে পানির স্রােত একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রীষ্মের আগেই দূষণ ও নাব্য সংকট এসব নদীর অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কাকেই জানান দিচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের হাত ধরে গত কয়েক দশকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছি আমরা। পক্ষান্তরে আমরা দেখছি আমাদের রাজধানী শহর বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য মেগাসিটিগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আর দেশের রাজধানী, বন্দরনগরীসহ প্রধান শহর ও জনপদগুলো বসাবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া, কলকারখানার তরল বর্জ্যে নদ-নদীর পানিতে মারাত্মক রাসায়নিক দূষণ, কারখানা ও ইটভাটার কালোধোঁয়ায় বাতাস ও পরিবেশগত দূষণে জনস্বাস্থ্য ও জনজীবনকে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়ার এহেন বাস্তবতাকে কোনোভাবেই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা চলে না। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারকে অবশ্যই নদনদী ও পরিবেশ দূষণ ও ভূমির অপরিণামদর্শী ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষত নদী দখল ও দূষণ বন্ধের পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও শিল্পকারখানার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন