শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মূল্যবোধের অবক্ষয় রুখতে হবে

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০২২, ১২:০৯ এএম

বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে রীতিনীতি। পরিবার ভেঙে হচ্ছে টুকরো টুকরো। ভালোবাসার বন্ধন ছিড়ে হচ্ছে খান খান। বড় পরিবার বা যৌথ পরিবার এখন সবার কাছেই ঝামেলা। ছোট পরিবার বা সংসার গড়তে এখন উদগ্রীব সবাই। শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা। ধর্ষক পুত্রের পক্ষ নিচ্ছেন বাবা। বলছেন, এ বয়সে এমন একটু আধটু হয়ই। তাতে দোষের কী? মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে সমাজ আজ থর থর করে কাঁপছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী ও শিশুর প্রতি সংহিসতা ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে ধর্ষণ, হত্যা ও শিশু নির্যাতনের খবর।

অন্যদিকে অভিভাবক ও সুবিধাবাদী কিছু মানুষও পরোক্ষভাবে শিশুদের ওপর করছেন এক ধরনের নির্যাতন। শিশুদের দিয়ে করানো হচ্ছে অমানবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আবার অভিভাবকরা ৫-৭ কেজি ওজনের একটি স্কুল ব্যাগ শিশুদের পিঠে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন, যা বহন করতে গিয়ে শিশুরা শারীরিক ও মাসনিকভাবে হয়ে পড়ছে অসুস্থ। এজন্য অনেক শিশু কোমর ও মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। এটাও এক ধরনের নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধাক্কায় তিলে তিলে গড়ে ওঠা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা পরিবারের ভেতরই সসদ্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে। প্রতিদিনের খবর পড়ে মনে হয়, আজকাল স্বামীর কাছে স্ত্রী নিরাপদ নয়, স্ত্রীর কাছেও নিরাপদ নয় স্বামী। নিরাপদ নয় মায়ের কাছে সন্তান, এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী। অপরূপা রূপসীরাও তাদের ভালবাসার স্বামীদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। নয়ন জুড়ানো, প্রাণ ভরানোর মতো আদরের সন্তানকেও তার আপন মমতাময়ী মায়ের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে, যা মনুষ্যত্বকে রীতিমত স্তম্ভিত ও হতবাক করছে; নিজ পরিবারের ভেতর যদি মানুষের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে আলোকিত বা ভালো মানুষ কীভাবে তৈরি হবে?

ভালো মানুষ বা অন্য ভালো যা অর্জন, তা সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই সূচিত হয়। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকটা পরিবারের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের প্রথম নিরাপত্তা তার পরিবারে। পরিবার বলতে টুকরো টুকরো পরিবার নয়, যৌথ পরিবার; যৌথ পরিবারে মানুষের মন-মনন ও নৈতিকতা-মূল্যবোধ এবং মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। আয়-উন্নতিও যৌথ পরিবারে বেশি হয়। সুতরাং যৌথ পরিবার গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে দিতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা; রাষ্ট্রের সার্বিক শাসন কাঠামোও হতে হবে যৌথ পরিবার গড়ার মুখী।

বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ত্রুমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে সমাজে দিন দিন ভয়ঙ্কর সব পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্র্যাজেডি, বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যাও। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়, বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে।

বর্তমানে তথ্যের দুনিয়ায় বাধাহীন, অবাধ বিচরণের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও বিদেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। ফলে সমাজ জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে বিপজ্জনক সব ভাইরাস, বয়ে নিয়ে আসছে অপসংস্কৃতি, অশ্লীল, উলঙ্গ ও বিকৃত সব ছবি। একদিকে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অন্যদিকে বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলোর যতসব অশ্লীল ও আপত্তিকর অনুষ্ঠান, তার ওপর ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা ও গাঁজা, আফিমসহ নেশার ছড়াছড়ি।


একটি রাষ্ট্রের মূল শক্তি হলো তার যুবশক্তি। এই যুব শক্তিই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে, সম্প্রসারিত করছে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার। গার্মেন্ট শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে যুবশক্তি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি যুবক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এসব খাত থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়েই মূলত বাংলাদেশ চলছে; বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে এবং বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুব শক্তির ওপর লোলপ দৃষ্টি পড়েছে। এই যুবশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। মগজ ধোলাই করে এই যুব শক্তিকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বানানো হচ্ছে। অন্যদিকে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ মাদক সরবরাহ করে যুবসমাজকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এটা অবশ্যই একটা ষড়যন্ত্র। এর গভীরে যেতে হবে, কারা তাদের মগজ ধোলাই করছে, তা বের করতে হবে ।

পারিবারিক মূল্যবোধের অবাব ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা সামাজিক অপারধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে আজ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতে ইন্টারনেট সংযোগসহ মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন। এই ফোনগুলোতে অনায়াসে অশ্ল­ীল ও পর্ন ছবি ডাউনলোড করা যায়। বন্ধুদের নিয়ে নির্জন জায়গায় বসে এসব পর্ন ছবি দেখে থাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা। এ থেকেই তাদের মাঝে লোভ-লালসা-মোহ ও অপারাধ প্রবণতা জাগ্রত হচ্ছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে। তাতে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতন। এ ব্যাপারে পরিবারের দায়িত্ব অপরিসীম। দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রেরও। কেননা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্তরাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।

সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, পরিবারের ভেতর ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক ধর্মেই সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়া-লেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়াও বাধ্যতামূলক।

ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্ল­ায়-মহল্ল­ায়, সর্বস্তরে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। সভা, সেমিনার গোলটেবিল বৈঠক, টিভি টকশো, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে এই সামাজিক আন্দোলনের অপরিহার্যতার বিষয়টি ‘ফোকাসে’ আনতে হবে। এছাড়াও আলেম সমাজ, মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belaYet_1@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
jack ali ১২ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ পিএম says : 0
আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা'আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং উনি জানেন কোনটা মানুষের জন্য ভালো এবং কোনটা মানুষের জন্য খারাপ এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আইন করে দিয়েছেন যে এইভাবে তোমরা সারা বিশ্ব শাসন করবে তাহলে তোমরা সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারবে
Total Reply(0)
jack ali ১২ মার্চ, ২০২২, ১২:০২ পিএম says : 0
মানবিক আচরণ নৈতিক মূল্যবোধ তখনই হবে যখন আমাদের দেশে আল্লাহর আইন দিয়ে দেশ চলবে এবং ক্লাস ওয়ান থেকে মাস্টার ডিগ্রী গ্রন্থ কোরআন হাদিসের শিক্ষা দিতে হবে তা হলেই মানুষ মানুষের মতো হবে আমাদের দেশটা চলে নরপিচাশদের দিয়ে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন