গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইরানে অনুষ্ঠিত ৩৮তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী হাফেজ সালে আহমাদ তাকরীম প্রথম স্থান অর্জন করেছে। তার এই অর্জন বিশ্ব দরবারে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে ৫ দেশের সেরা প্রতিযোগিদের মাঝে হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীম সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। গত শানিবার পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা সমাপ্ত হয়। গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী পরীক্ষায় হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীমকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। তাকরীম রাজধানীর মিরপুরস্থ মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামীর শিক্ষার্থী। তার পিতা হাফেজ আব্দুর রহমান মাদরাসা শিক্ষক ও মা গৃহিণী। তার এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য মারকাযু ফয়জিল কুরআনের প্রিন্সিপাল এবং গুলশান সোসাইটি ফর মসজিদের খতিব মুফতি মুরতাজা হাসান ফয়েজী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা গত দুই বছর কুয়েত, মিশর ও আলজেরিয়ায় আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতার বাছাইয়ে চূড়ান্ত প্রতিনিধি মনোনীত হলেও করোনার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীমের এই অর্জন বিশ্বে শুধু দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করেনি, ইসলামের প্রসারেও ভূমিকা রেখেছে। আমরা এই অনবদ্য ও অসাধারণ অর্জনে তাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
কুরআনে হাফেজকে বলা হয় ‘জীবন্ত কুরআন’। তার মনে পুরো কুরআন সংরক্ষিত থাকে। কুরআন ধারণ করা যেমন অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ, তেমনি মহান আল্লাহর এ এক অসীম রহমত। আমাদের দেশে অসংখ্য কুরআনে হাফেজ রয়েছে। তারা সম্পদে পরিণত হয়েছে। নীরবে-নিভৃতে ইসলামের খেদমতে তারা কাজ করে যাচ্ছে। তাদের খোঁজ-খবর খুব কম মানুষই রাখে। অগোচর ও অন্তরালে থাকা এই হাফেজরাই বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। কখনো চ্যাম্পিয়ন, কখনো প্রথম সারিতে স্থান পাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরীম ইরানে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে কঠিন এক পরীক্ষায় তার এই অর্জন অসামান্য। আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছর ধরে রমজানে দুয়েকটি টেলিভিশনে কুরআনে হাফেজদের নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। রমজানের পুরো মাস ধরে এই প্রতিযোগিতা চলে। ঈদের আগেই ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অথচ প্রতিবছরই অনেকে কুরআনে হাফেজ হচ্ছে। এ বিষয়টি তেমন প্রচার-প্রচারণা পায় না। যখন কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হয়, তখনও আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো এ সংবাদ প্রকাশে কুণ্ঠাবোধ করে। কুরআনে হাফেজরা যে শুধু ইসলামের খেদমত করে তা নয়, তারা বিশেষায়িত পেশা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তৈরি হলেও, কুরআনে হাফেজ কিংবা একজন দক্ষ ইমাম ও আলেম তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে জোরালো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। কিছু ডেডিকেটেড আলেম, হাফেজ ও ইসলামী ব্যক্তিদের উদ্যোগে এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তায় সিংহভাগ হাফেজ, ইমাম ও আলেম তৈরি হচ্ছে। তারাও যে বিশেষায়িত পেশাজীবী হতে পারে, সরকার এ বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভেবেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোতে সংখ্যার দিক দিয়ে হাফেজ ও ইমাম কম। অথচ আরবী ভাষা হওয়ায় ওইসব দেশেই এ সুযোগ বেশি। দেখা যায়, বাংলাদেশসহ অনারব দেশ থেকে যাওয়া হাফেজ-ইমাম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দায়িত্ব পালন করছে। এও লক্ষ্যযোগ্য, বিশ্বজুড়েই হাফেজ-ইমামের চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক কুরআনে হাফেজ ও ইমাম তৈরি হচ্ছে, তাদেরকে যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো যায়, তাতে তাদের কর্মসংস্থান হবে, দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আরবীর পাশাপাশি ইংরেজী ভাষায়ও যাতে তারা দক্ষ হতে পারে তার ব্যবস্থা নিলে কর্মসংস্থান সহজ হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুরআনে হাফেজ ও ইমামের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সরকারের উচিৎ দেশের হাফেজ ও ইমামদের উন্নত প্রশিক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এক্ষেত্রে তার কর্মপরিধিকে আরও বিস্তৃত করতে পারে।
যেসব মাদরাসা কুরআনের হাফেজ ও ইমাম তৈরিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, সরকারী উদ্যোগে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া জরুরি। বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বাজারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রফতানি খাত সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে জনশক্তি রফতানি অন্যতম বৃহত্তম খাত। এ খাতের সাথে বিশেষায়িত জনশক্তি হিসেবে দক্ষ হাফেজ, ইমাম ও আলেমদের যুক্ত করা হলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা যেমন অর্জিত হবে, তেমনি বিশ্বে ইসলামের খেদমতের পথও প্রসারিত হবে। এতে দেশের ভাবমর্যাদাও উজ্জ্বল হবে। বিষয়টি বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দক্ষ হাফেজ, ইমাম ও আলেম তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন