শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রফতানি বাড়াতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চলতি অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে অর্থনৈতিক সূচকে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গার্মেন্টস রফতানিকারকরা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হলেও বৈদেশিক রেমিট্যান্সে ঋণাত্মক প্রবণতা এক ধরনের আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসের আমদানি-রফতানির আনুপাতিক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দ্বিগুণের বেশী। শতকরা হিসেবে ১১১ ভাগ। গত অর্থ বছরের প্রথম কোয়ার্টারে যেখানে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১.১২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়লেও আমদানি ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ায় বাণিজ্যবৈষম্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের আমদানি-রফতানি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবণতাই ধরা পড়েছে। গত কয়েক মাস ধরেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক আশা ও নিরাশার বাণী শোনা যাচ্ছিল। সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আত্মতুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার চিত্রও পাওয়া যাচ্ছিল। রেমিটেন্স হ্রাস, বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈষম্য বৃদ্ধির চলমান চিত্র থেকে অর্থনৈতিক মানদ-ে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিই ফুটে উঠেছে।
দেশে নতুন বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থানের পথও অনেকটাই রুদ্ধ। এহেন বাস্তবতায় আমদানি খরচ বিগত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশী বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা সুখকর নয়। অনুৎপাদনশীল খাতে আমদানি দ্বিগুণ বেড়ে গেলেও রফতানি প্রবৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রবণতার এই ধারায় শংকা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক মাস এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং আমদানি ব্যয় আরো বাড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কেউ কেউ অবশ্য গার্মেন্টসের মেশিনারিজ আমদানি খাতে ব্যয়বৃদ্ধিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে হঠাৎ আমদানি ব্যয়বৃদ্ধির সূত্রে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতির কারণে হয়তো উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কিছু নেই। এমনকি পদ্মাসেতুসহ বড় বড় অবকাঠামোগত মেগাপ্রকল্পের জন্য কাঁচামাল ও মেশিনারিজের আমদানির কারণেও এমন বাণিজ্য ঘাটতি দৃশ্যমান হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রফতানি আয় হয়েছিল ৭.৬৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরে তা ৩.৫২ ভাগ বেড়ে ৭.৯১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। রফতানি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে হতাশাজনক কিছু না থাকলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার চলমান বাস্তবতা সম্পর্কে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। অর্থবছরের সামগ্রিক বিন্যাসে আমদানি-রফতানির ব্যবধান কমিয়ে আনার কার্যকর ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র সম্পর্কে এক্ষণি পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে নানা মাধ্যমে খবর বেরোচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৭৪তম স্থানে নেমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর এই সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭২তম। সরকার যখন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে বলে দাবি করছে এবং আগামী দশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলছে, তখন দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স প্রবাহে কাক্সিক্ষত গতি নেই। উপরন্তু প্রধান রফতানিমুখী খাত তৈরী পোশাক রফতানিতে নতুন নতুন সংকট বা চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পোশাক শ্রমিকসহ কর্মজীবী মানুষের বেতন ও আয়বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়। আয়কর বৃদ্ধি ও আয়করের পরিধি বাড়িয়ে সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করলেও মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির বিপরীতে জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু দেশে নিরাপত্তার ঘাটতির দোহাই দিয়ে তৈরী পোশাকের ক্রেতারা মূল্য কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় তৈরী পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক বিকল্প বাজারের সন্ধান করার পাশাপাশি রফতানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পুঁজিপাচার এবং ব্যাংকিং সেক্টরের বিশৃঙ্খলা ও অস্বচ্ছতা দূর করতে হবে। সেই সাথে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস সামগ্রী আমদানি কমিয়ে আমদানি-রফতানির বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। ভারতের মত বড় প্রতিবেশীর সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে টেরিফ ও নন-টেরিফ ব্যারিয়ার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি দেশে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন