বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বন-বৃক্ষ বাঁচিয়ে পরিবেশ বিপর্যয় রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০২২, ১২:০৬ এএম

চকোরিয়া সুন্দরবন নামে পরিচিত বনভূমির সামান্য অংশই এখন টিকে আছে। খুলনা-সাতক্ষীরার বিখ্যাত সুন্দরবনের চেয়েও প্রাচীন বলে কথিত এই বনভূমি বিস্তৃত ছিল হাজার হাজার একর এলাকা জুড়ে। একদা চকোরিয়া সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় বেড়া এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকার উপায় হিসেবে কাজ করেছে। জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়েও এর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। তিন দশকের মধ্যে এই বনভূমির অস্তিত্ব নিঃশেষ হতে বসেছে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলে চিংড়ি চাষের জন্য এই বনভূমি লিজ দেয়ার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এইসঙ্গে লবণ চাষেরও অনুমোদন দেয়া হয়। বন-এলাকা জুড়ে ইচ্ছেমতো চিংড়ি ও লবণচাষ হওয়ার ফলে বন-বৃক্ষ উজাড় হয়েছে, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়েছে। এরূপ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উপকূলীয় এলাকায় আরো অনেক বনবেষ্টনী ও বন হারিয়ে গেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনও হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি এলাকায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই এলাকায় অন্যান্য শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। পরিবেশবাদীদের আশংকা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানার ধুয়া বা বর্জ্যে সুন্দরবন মরাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হবে এবং বৃক্ষ, জীবজন্তু ও পাখপাখালীর সমূহ ক্ষতি হবে। আখেরে এই বনের অস্তিত্বই হয়তো হারিয়ে যাবে। সরকার এসব আশংকার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। বলা বাহুল্য, চকোরিয়া সুন্দরবন কিংবা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন মানুষ ইচ্ছা করলেই বানাতে পারবে না। প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিক প্রয়োজনেই এধরনের বন সৃষ্টি হয়েছে। চিংড়ি বা লবণচাষ অন্য কোথাও হতে পারে। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বা শিল্পকারখানা তৈরির জায়গারও অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই বন এড়িয়ে এসব তৈরি করা যায়। অথচ, তা না করে বনভূমি বিনাশের আশংকার পথই বেছে নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ করা দরকার, এক সময় উপকূলজুড়ে বনবেষ্টনী বা সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এই বনবেষ্টনী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস প্রতিরোধে যেমন ভূমিকা রাখতো, তেমনি অনেকের আয়-রোজগারের পথ হিসেবেও কাজে লাগতো। দুঃখের বিষয়, এই বনষ্টেনীর অস্তিত্ব এখন অধিকাংশ উপকূল এলাকাতেই নেই।
নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড় আমাদের দেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে পরিবেশ বিপর্যয় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় বন-বৃক্ষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো দেশের কাক্সিক্ষত পরিবেশের জন্য মোট ভূমির ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা অপরিহার্য। আমাদের দেশে আছে এর অর্ধেকেরও কম। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার বিশ্বকে অবিশ্বাস্য পরিবেশ সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। এতে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। উচ্চতা বাড়ছে, বরফ গলছে, সমুদ্র স্ফীত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমিধস বজ্রপাত ইত্যাদি বাড়ছে। আমাদের দেশেও এসব এখন বেশি বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত সবচেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাযুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমুদ্রে পানির স্ফীতি একটা সময় এমন বাড়তে পারে, যখন আমাদের উপকূলীয় এলাকায় বিরাট অংশ সমুদ্রের নিচে চলে যাবে। তখন অন্যান্য ক্ষতির সঙ্গে কয়েক কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। আরো অনেক দেশেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পরিবেশের বিপর্যয় কীভাবে ঠেকানো যায়, কীভাবে পরিবেশ উন্নত করে মানুষের বসবাস ও জীবিকা নিরাপদ করা যায়, তার চিন্তা-ভাবনা চলছে অবিরাম। এ ব্যাপারে ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে নানা পথ ও উপায়ের কথা বলা হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং বনায়ন-বৃক্ষায়ন জোরদার করা কাম্য পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশের পরিবেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে অবনত এবং ভবিষ্যতের জন্য আশংকাজনক, সুতরাং আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমিত ব্যবহার যেমন করতে হবে, তেমনি বনায়ন বৃক্ষায়নে আগ্রাধিকার দিতে হবে।
একদা কাম্য বনভূমি আমাদের দেশেও ছিল। নানা কারণে তা উজাড় বা ধ্বংস হতে হতে এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, গত ১৫ বছরে বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ৪ শতাংশ বনভূমি উজাড় হয়েছে। অথচ, এই সময়ে বাংলাদেশে উজাড় হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। জানা যায়, দেশে বছরে ২ হাজার ৬শ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়। এ থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলও রক্ষা পায় না। সব বন সংকুচিত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এর মধ্যে সুন্দরবনও রয়েছে। সুন্দরবন আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এক সময় দেশে ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটারে বনের বিস্তার ছিল। এখন তা কমে ৬ হাজার ৪শ ৬৭ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। বনভূমি দখলের পাশাপাশি বিলীন হয়ে যাওয়াই এর কারণ। পরিবেশ ও আবহাওয়ার জন্য বৃক্ষ ও বনভূমির ভূমিকা ও অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কার্বন ও কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ এবং অক্সিজেনের জোগানের জন্য আমাদের বৃক্ষের ওপরই নির্ভর করতে হয়। বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাই আমাদের বৃক্ষ রোপণ করতে হবে এবং রোপিত বৃক্ষ রক্ষা করতে হবে। বনভূমি দখলমুক্ত করতে হবে এবং অর্জিত দখল বজায় রাখতে হবে। নতুন নতুন বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। বনভূমির ক্ষতি হয়, এমন কিছু থেকে বিরত থাকতে হবে। উপকূলে বৃক্ষবেষ্টনী, সামাজিক বনায়ন এবং সবুজায়ন কর্মসূচি জোরালো করতে হবে। বন ও বৃক্ষের যারা শত্রু, দখলকারী, ঘাতক ও বিনাশকারী তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন