বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন এবং কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্রমেই উঁচু হচ্ছে অবিশ্বাসের দেয়াল। শরীফ-কান্ডের পর গঠিত হয় ‘দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ (দুসা)। ৫৪(২) ধারায় সংস্থার উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনকে চাকরিচ্যুত করার প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় এই সংগঠন। শরীফ উদ্দীনকে চাকরিচ্যুত করার পর কর্মকর্তা-কর্মকর্তাদের মধ্যে সঞ্চার হয় ভয়ার্ত পরিবেশ। এ প্রেক্ষাপটে দুদক চাকরি বিধি-২০০৮-এর ৫৪(২) ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনের কাছে কাজের জন্য নিঃশঙ্ক পরিবেশ চান।
কমিশনের পক্ষে সংস্থার সচিব মো. মাহবুব হোসেন আন্দোলনরতদের এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে, নতুন করে কারো বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা (ডিপি) নেয়া হবে না। চাকরিচ্যুতও করা হবে না কাউকে। কর্মকর্তারা নির্ভয়ে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারবেন। কিন্তু এই আশ্বাসের পরও ভয়মুক্ত হতে পারছেন না দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নানা সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাদের আশঙ্কা- সংস্থাটিতে প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নতুন কোনো অজুহাতে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর আবারও খড়্গহস্ত হতে পারেন। সে আলামত এখন স্পষ্ট।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা আলাপচারিতায় জানান, আমলা-শাসিত কমিশন এখন কৌশলে নতুন খেলা শুরু করেছেন। সংস্থাটিতে প্রেষণে আসা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের মুখোমুখি করতে চাইছেন তারা। এ লক্ষ্যে সংস্থার আইন অনুবিভাগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
বর্তমান প্রক্রিয়া কমিশন, দুদকের কোনো মামলার বিচারে পরাজিত হলে আইনজীবীদের দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের ত্রæটি-বিচ্যুতি খুঁজে দেখা হচ্ছে। কেন মামলায় দুদক হেরে গেলÑ এর কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন আদালতে নিযুক্ত প্যানেলভুক্ত অস্থায়ী আইনজীবীদের। ওই আইনজীবীরা তিন সদস্যের কমিশন, তদারক কর্মকর্তা এবং মামলা সংশ্লিষ্ট সবার দায়দায়িত্ব বিবেচনায় না নিয়ে শুধু তদন্ত কর্মকর্তার ‘ত্রæটিপূর্ণ তদন্ত’কে দায়ী করে মতামত দিচ্ছেন।
ওই মতামতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরও যে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব রয়েছেÑ সেটিও চেপে যাওয়া হচ্ছে এবং এ ধরনের ‘আইনজীবীর মতামত’র ভিত্তিতে কমিশন এরই মধ্যে অন্তত ২০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ‘মামলা ব্যবস্থা’র ফাইল খুলেছে। এর ফলে দুদকের আইন অনুবিভাগ এবং কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য, আইন অনুবিভাগের কর্মকর্তারা দুদকে পদায়ন হয়ে থাকেন প্রেষণে। তারা বিচার বিভাগীয় সার্ভিস থেকে এখানে নিয়োগ পান। দুর্নীতির প্রায় সব অনুসন্ধান-তদন্ত আইন অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তাদের কোনো মামলায় সাক্ষী করা হয় না। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই সত্যিকারার্থে কমিশনে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩৩ (১) ধারা অনুসারে কমিশনের একটি নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু ১৮ বছরেও নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠিত হয়নি। প্রতিটি কমিশনই এ প্রশ্নে কেবল কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে। এর ফলে আইন ও বিচার প্রশ্নে কমিশনের পরনির্ভরতা এখনও কাটেনি। আইন অনুবিভাগকে পরিণত করা হয়েছে আইনজীবী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। গত ১৮ বছর দুদকের আইন অনুবিভাগে প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ পেয়েছেন কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এবং ‘খাতির’-এর লোক। কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় না।
এ ধারায় নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের সঙ্গে কমিশনের চুক্তি হচ্ছে ‘কেস টু কেস’। সে অনুযায়ী তাদের পারিতোষিক দেয়া হয়। এই পারিতোষিকেরও নেই কোনো মানদÐ। তদুপরি প্রথিতযশা কোনো আইনজীবীদের দুদক কখনোই প্যানেলভুক্ত করতে পারেনি। অদক্ষ, অযোগ্য, আনাড়ি আইনজীবীরাই থাকেন দুদকের আইন অনুবিভাগের পছন্দের তালিকায়। হালনাগাদ আইন সম্পর্কে এই আইনজীবীদের নেই কোনো ধারণা। আর্থিক অপরাধ সংক্রান্ত আইন, তদন্ত, মানিলন্ডারিং, অপরাধলব্ধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে তাদের বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
প্যানেল আইনজীবীদের অনেকের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসামির পক্ষে কাজ করার। দুর্নীতি মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতাও পরীক্ষিত নয়। তথাপি কমিশন যদি মনে করে কোনো মামলার বিচারে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সে ক্ষেত্রে নিযুক্ত প্যানেল আইনজীবীর কাছ থেকে মতামত নিয়ে মামলা দায়ের এবং চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিতে পারে।
সেটি না করে মামলায় হেরে যাওয়ার পর প্যানেল আইনজীবীদের মতামত নেয়ার কি তাৎপর্য থাকতে পারেÑ এই প্রশ্ন তুলেছেন দুদক সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এর একটিই তাৎপর্য হতে পারে তা হলো, অস্থায়ী আইনজীবীদের দিয়ে কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তাদের শায়েস্তা করা। দুদক কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে যা বর্তমান আমলা নিয়ন্ত্রিত কমিশনের নতুন কূটকৌশল।
রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী থানা মামলা নং-৫১ (০৬)২০১৬। এ থেকে উদ্ভ‚ত বিশেষ মামলা নং-০৭/১৭। মামলাটিতে দুদক নিযুক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. রেজাউল করিম রেজা হেরে যান। কিন্তু নিজের ব্যর্থতা আড়াল করে মামলায় হেরে যাওয়ার কারণ হিসেবে ‘ত্রæটিপূর্ণ চার্জশিট দাখিল’কে দায়ী করে মতামত দেন।
ওই মতামতের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘অদক্ষতা’ ও ‘দায়িত্বে অবহেলা’র অভিযোগ এনে কারণ দর্শানো নোটিশ জারিকরত গত ২৩ ফেব্রæয়ারি বিভাগীয় মামলা রুজুর সুপারিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.২০৪.৩২.০২৩.২১.৫২) করেন দুদকের উপ-পরিচালক (প্রসিকিউশন) সাবরিনা নার্গিস।
দুদক নিযুক্ত ঢাকার পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আরেকটি মামলায় [গেন্ডারিয়া থানার মামলা নং-২৪(০৬)২০১৬ থেকে উদ্ভ‚ত মামলা নং-০৭/১৭)] হেরে যাওয়ার কারণ হিসেবে ‘ত্রæটিপূর্ণ চার্জশিট’ এবং তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘অদক্ষতা’ ও ‘দায়িত্বে অবহেলা’র অভিযোগ এনে মতামত দেন।
ওই মতামতের ভিত্তিতে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারিকরত তার বিরুদ্ধে গত ২৩ ফেব্রæয়ারি বিভাগীয় মামলা রুজুর সুপারিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.২০৪.৩২.০২৩.২১.৫৮) করেন উপ-পরিচালক (প্রসিকিউশন) সাবরিনা নার্গিস। কমিশন সভায় বিভাগীয় মামলা রুজুর সিদ্ধান্তও (নং-০৬/২০২২) হয়।
সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আমলা নিয়ন্ত্রিত দুদক প্রশাসন এখন অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আইনজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে একের পর এক বিভাগীয় মামলা রুজু অব্যাহত রেখেছেন দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে তদন্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে ভয়ার্ত পরিবেশ।
আলোচিত কয়েকটি মামলার উপ-পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, কাজ করলেই যদি ডিপি খেতে হয়, চাকরি চলে যায়Ñ তাহলে আর কাজ করব কিভাবে। এ কারণে আপাতত চুপচাপ আছি। কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
দুদক চাকরিবিধির ৫৪(২) ধারা বাতিল আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেক উপ-পরিচালক বলেন, দুদক সচিব আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন দুদক অফিসারদের বিরুদ্ধে আর কোনো ডিপি হবে না। কিন্তু তারপরও ডিপি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত প্যানেল আইনজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে অন্তত ২০টি ডিপি ফাইল হয়েছে। আমরা কমিশনের ওপর কিভাবে আস্থা রাখব? দুদক তো প্রশাসন ক্যাডারদের দখলে। আমাদের শায়েস্তা করার জন্য তারা নতুন কি ফন্দি আঁটছে কে জানে! এ কারণেই দুদক অফিসাররা এখন ভয়ে আছে। তাদের মধ্যে প্রচন্ড আতঙ্ক কাজ করছে। কমিশনের কোনো আশ্বাসেই আমাদের ভয় ভাঙছে না। দুদকে কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের ভয়মুক্ত করতে হবে। এটি কমিশনেরই দায়িত্ব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন