দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার ৪৩টি উপজেলার ৩৮১ ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার গ্রামে বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে ২৩ লাখ গ্রাহককে সংযোগের আওতায় এনে শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এ অঞ্চলের ৬টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২০ লাখ ৫২ হাজার আবাসিক গ্রাহকসহ বাণিজ্যিক, শিল্প, সেচ ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দিয়েছে আরইবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ মার্চ দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র উদ্বোধনকালে শতভাগ বিদ্যুতায়নেরও ঘোষণা দেন।
এমনকি ভোলার দূর্গম চরাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার গ্রাহককে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নবায়নযোগ্য জ¦ালানী সুবিধা নিশ্চিত করেছে। ফলে নিকট অতীতের ঘুমন্ত দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামঞ্চলে এখন দিনরাতই প্রাণের স্পন্দন সজিব রয়েছে। এক সময় শহরের বাইরে বিশাল পল্লী অঞ্চল সন্ধ্যার পরে ঘুমিয়ে পড়লেও এখন সেখানে গভীর রাত পর্যন্তই প্রাণ চাঞ্চল্য। ফলে এ অঞ্চলের অর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে ইতোমধ্যে। শহরের মতো পল্লী এলাকায়ও শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটছে।
১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠনের পাঁচ বছর পরে ১৯৮২ সালের ৮ মে পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামে সর্বপ্রথম বিদ্যুতায়নের কার্যক্রমের সূচনা হয়। এরপরে পর্যায়ক্রমে বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিÑ১ ও ২, পটুয়াখালী, ভোলা ও ঝালকাঠী জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার ৪ হাজার ৭৭২টি গ্রামের ২২ লাখ ৯৩ হাজার ৫১১ জন গ্রাককে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে ৬৮টি ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশন নির্মিত হয়েছে ইতোমধ্যে।
এমনকি এ অঞ্চলে শুধু পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকদেরই সান্ধ্য পীক আওয়ারে বিদ্যুৎ চাহিদা এখন প্রায় ৩৮৭ মেগাওয়াট। যা নিকট অতীতে বিদ্যুৎ বিভাগের পশ্চিম জোনের ২১টি জেলার মোট চাহিদারও প্রায় দ্বিগুন। আর এ বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে ৩৩ কেভি ১১ কেভি ও .০৪ কেভি লাইন নির্মাণ করা হয়েছে ৫৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।
তবে এ অঞ্চলে শিল্প কারখানা ও সেচ গ্রাহক কম হওয়ায় সবগুলো সমিতিই প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লোকশান গুনছে। সরকারি ভর্তূকি ও মুনাফা লাভকারী অন্য সমিতগুলোর কাছ থেকে ধার করে টিকে থাকলেও অদুর ভবিষ্যতে এসব সমিতিকে আত্মনির্ভরশীল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ওয়াকিবাহাল মহল। এসমস্যার সমাধান সূত্রও খুঁজছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডসহ বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো কিছু লোকশান গুনলেও পল্লী এলাকার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায় এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, লাভ-লোকাশানে তার হিসেব মেলান ঠিক হবে না বলেও মনে করছেন ওয়াকিবাহল মহল।
দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর তলদেশে ৩৩ হাজার ভোল্টের প্রায় ৩০ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবলও স্থাপন করেছে। শুধুমাত্র পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১০৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে আরইবি ২৬ কিলোমিটার ৩৩ কেভী ওভারহেড লাইন ছাড়াও তেতুলিয়া, কাজল ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তরলদেশে ৫.৩৮ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করেছে। নদী বেষ্টিত রাঙ্গাবালী উপজেলার ২৮ সহস্রাধিক গ্রাহককে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে ২৬০ কোটি টাকা ব্যায় হলেও ইতোমধ্যে প্রায় ২২ হাজার আবাসিক ও সাড়ে ৩ হাজার বাণিজ্যিক গ্রাহকসহ ২৫ হাজার ৫শ’ মতো গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করেছে পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। মাত্র ১৪ মাসে দক্ষিণে সাগর পাড়ের নদী বেষ্টিত নব সৃষ্ট রাঙ্গাবালী উপেজলায় এ বিপুল অর্থ ব্যায়ে ৩৫ কিলোমিটার দুরে গ্রীড লাইন থেকে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠনের পরে ঐ বছরই ঢাকা পল্লী বিদুৎ সমিতি-১’এর কার্যক্রম শুরু হয়।
ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, কুয়েত উন্নয়ন তহবিল, জাপান উন্নয়ন সংস্থা ও মার্কিন সাহায্য সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি দাতা দেশ ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তায় দেশের ৬৪টি জেলায় এ পর্যন্ত ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে পল্লী এলাকার প্রায় সোয়া ৩ কোটি গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে আরইবি। যা আজ দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবীদগণ।
এব্যাপারে আরইবি’র বরিশাল অঞ্চলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দীপঙ্কর মন্ডল জানান, দক্ষিণাঞ্চলের পল্লী এলাকার শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিতে আরইবি’র প্রতিটি কর্মী গত কয়েকটি বছর নিরলশ পরিশ্রম করেছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের দূর্গম চরাঞ্চলও বিদ্যুতের আলোতে ঝলমল করছে। এটা এখন বাস্তব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী এবং দুরদর্শী পদক্ষেপ ও অনুপ্রেরণায় আরইবি’র চেয়ারম্যানের নিবিড় নজরদারিতেই এ দুঃসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন