সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

‘মৃত্যুবোমা’ সিলিন্ডারে বাড়ছে দুর্ঘটনা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০২২, ১২:০২ এএম

অন্যান্য দিনের মতোই গত মঙ্গলবার বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় নিজ বাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুমাতে যান ব্যবসায়ী মো. সাহিদ হাসান (৩৭)। রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। এতে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। অল্প সময়ের মধ্যেই দগ্ধ হন তিনিসহ স্ত্রী রেখা আক্তার (৩৫), মেয়ে সাফা (১০) ও ছেলে সাফিয়ান (৯)। গত বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন সাহিদ হাসানের মৃত্যু হয়। তার শরীরের ৯৮ শতাংশ পুড়ে যায়।
বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনসহ নানা স্থানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার। কিন্তু এসব সিলিন্ডার ব্যবহারে কার্যকর নীতিমালা ও তদারকি না থাকায় বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনাও বাড়ছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ছাড়াও শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে শত শত মানুষ। সিলিন্ডার এখন ‘মৃত্যুবোমায়’ পরিণত হয়েছে। গত দু’মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৩০টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ৩৫ জনের প্রাণহানি ও অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর সিলিন্ডার বিস্ফোরণে (গ্যাস ও বয়লার) ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ৭৫ জন আহত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে বেশিরভাগ বাসাবাড়ি ও যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা তদারকি ছাড়াই বছরের পর বছর ব্যবহৃত হচ্ছে সিলিন্ডারগুলো। মানহীন সিলিন্ডার ও বাসা-বাড়িতে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারায় লিকেজ থেকে গ্যাস জমে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।
বিস্ফোরক অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয় না, সিলিন্ডারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিস্ফোরিত হয়। এর জন্য নিম্নমানের এক্সেসরিজ তৈরি ও বাজারজাতকারীরা যেমন দায়ী, তেমনি নিম্নমানের পণ্য ক্রেতারাও দায়ী। কোনো সংস্থার মাধ্যমে মান যাচাইসহ কঠোরভাবে মনিটরিং করার কথা বলেন ওই দুই কর্মকর্তা। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা) দিনমণি শর্মা সাংবাদিকদের বলেন, মানসম্মত সিলিন্ডার বা সিলিন্ডার সামগ্রী ব্যবহার না করায় গ্যাস লিকেজসহ বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। এজন্য বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুলা জ্বালানোর আগে গ্যাসের উপস্থিতিসহ সিলিন্ডারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঠিক আছে কি না, নিয়মিত যাচাই করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১২টি দোকান পুড়ে গেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনে পুড়ে তিন (শিশু) সহোদর ভাই-বোনের মৃত্যু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশু-নারীসহ ১১ জন দগ্ধ হয়, যাদের মধ্যে মারা যায় তিনজন। ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে একটি হোটেলের রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৬ জন দগ্ধ হয়। একইদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক শিশু নিহত ও ১২ জন আহত হয়। এর আগে গত জানুয়ারিতে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে হিলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩৫ শিশুসহ ৪০ জন আহত হয়, যার মধ্যে এক শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা গেছে, সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ যানবাহন মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ সিএনজি সিলিন্ডার নিয়ে চলাচল করছে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর এসব সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বিস্ফোরক অধিদফতরে রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা থাকলেও সেটি যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার গাড়ি নিয়মিত এই পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ায় বড় অংশই ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাজপথে চলাচল করছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে (গ্যাস ও বয়লার) ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ৭৫ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস সরবরাহ ও গ্যাসলাইন থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৭৮৯টি। এসব ঘটনায় দুজন নিহত ও ৮৮ জন আহত হয়। বাস্তবে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা।
গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে। এর বড় অংশই গ্রামাঞ্চলে বাস করে। দেশের বাজারে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি কোম্পানির অন্তত ২ কোটি সিলিন্ডার রয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরক পরিদফতরের এক তথ্যে দেখা গেছে, গত এক বছরে ৬ লাখ ১৩ হাজার ৩২৩টি এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে। এলপিজি ছাড়া অন্যান্য সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ১৯০টি। পাশাপাশি দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সিলিন্ডার নির্মাণের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে নির্মিত ৩৫ লাখ ৮২৯টি এলপিজি সিলিন্ডার বাজারজাত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিলিন্ডারের হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভের ত্রুটি থেকে গ্যাস লিক হয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব গ্যাস বাইরে কোথাও জমে থাকে এবং সামান্য আগুন পেলেই ধরে যায়। এ কারণে লিকেজের বিষয়ে সব থেকে বেশি সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেন অভিজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগে দেখতে হবে, সিলিন্ডার ও এর সঙ্গে যুক্ত ভালভের মেয়াদ এবং সেখানে কোনো ছিদ্র আছে কি না। বাসা-বাড়িতে নিরাপদ জায়গায় সিলিন্ডার রাখাসহ রান্নার আগে-পরে রেগুলেটর ভালোভাবে পরীক্ষা করে চুলা জ্বালানো উচিত। এ ছাড়া সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোরও উচিত, বাজারজাত করার আগে সিলিন্ডারের মান কঠোরভাবে যাচাই ও পরে তদারক করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন