সংস্কৃতি কী, একথা শুনতেই আমরা সাধারণভাবে আমাদের চারপাশে চলমান নাট্যচর্চা, চিত্রকলা, প্রত্নতত্ত্ব, ললিতকলা, সঙ্গীত, সাহিত্য ও কাব্যচর্চা বা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ইণ্যাদি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসি এবং মনে করি, এগুলিই আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু বিষয়টি শুধু সেরকম নয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ বিভিন্নভাবে সংস্কৃতির ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন করেছেন। এডওয়ার্ড টেইলরের মতে, মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং জ্ঞানের একটি সমন্বিত প্যাটার্নকে সংস্কৃতি বলা যায়। ভাষা, সাহিত্য, ধারণা, ধর্ম ও বিশ্বাস, রীতিনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন, উৎসব, শিল্পকর্ম এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হয় এমন জিনিসপত্র বা হাতিয়ার ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি। এমনকি, সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যেসব শিক্ষা, সামর্থ্য এবং অভ্যাস আয়ত্ত করে, তাও সংস্কৃতির অংশ। বিখ্যাত লেখক ও অনুবাদক অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারুক তাঁর সংস্কৃতির রূপায়ন গ্রন্থে বলেন, ‘সংস্কার শব্দ থেকে সংস্কৃতি শব্দের উৎপত্তি। সংস্কার প্রাপ্ত মার্জিত মানসিকতাই সংস্কৃতি।’ রাগেব আল বৈরুতী তাঁর ‘আস-সাকাফাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সাকাফাহ’ (সংস্কৃতি) মানে মানসিকতার সঠিক ও পূর্ণ সংশোধন এমনভাবে যে, সংস্কৃতিবান ব্যক্তির সত্তা পরিপূর্ণতা ও অধিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের দর্পণ হবে।
ইসলামি সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? সাধারণ ও সরল কথায় শাশ্বত জীবন বিধান ইসলাম মানবজাতির জন্য যে সংস্কৃতির শিক্ষা দেয় তা-ই হলো ইসলামি সংস্কৃতি। যার আদি বা মূল উৎস হলো ঐশী গ্রন্থ আল কোরআন ও প্রিয়নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের) সুন্নাহ। মিশরের প্রখ্যাত ইসলামি দার্শনিক অধ্যাপক হাছান আইয়ুব ইসলামি সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক মানুষের সামষ্টিক জীবনের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, প্রত্যয়, আবেগ-অনুভূতি, অনুরাগ, মূল্যবোধ, কর্মকাণ্ড, আচরণ, সৎকর্মশীলতা, উন্নত নৈতিকতা তথা জীবনের পরিমার্জিত ও পরিশোধিু সকল কর্মকাণ্ড, মানুষের পরিপূর্ণ জীবনধারা ও পরিমণ্ডলই ইসলামি সংস্কৃতির আওতাধীন।’ ইসলামি সংস্কৃতির মূল ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহ বিধায় তা বাস্তবতা ও মানবিকতার উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ। বিশ্বে একমাত্র সার্বজনীন, বিশুদ্ধ, পরিমার্জিত, পরিশীলিত, রুচি ও মর্যাদাপূর্ণ এবং কল্যাণকর সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি। এতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই, নেই কোনো অবাস্তব, অসুন্দর, অনৈতিক, অশোভন, অশালীন ও অমর্যাদাকর বিষয়।
ইসলামি সংস্কৃতি একটি মানবতাবাদী সংস্কৃতি এবং সম্পূর্ণভাবে একটি মানসিক শিল্প। ইসলামি সংস্কৃতি মানুষকে ইহজাগতিক সফলতা, শান্তি, মর্যাদা এবং পরজাগতিক মুক্তির পথকে সুগম করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যাতে জন্ম থেকে মৃত্যু এবং তার পরবর্তী অবিনশ্বরর জগৎ পর্যন্ত নির্দেশিকা রয়েছে। পবিত্র কুরআনুল করীমে আল্লাহপাক ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং আমি ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়েদা)। একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার ডান কানে আযান দেয়া, একটি সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা, আকিকা করা, প্রথম কথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শিক্ষা দেয়া, খতনা করানো, কুরআন তেলাওয়াতের অভ্যাস করানো, নির্দিষ্ট বয়সে সালাতের তাগিদ দেয়া, উপযুক্ত ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা করা, এভাবে ধীরে ধীরে ইসলামি সংস্কৃতির উপাদানগুলো শিক্ষা দিয়ে একজন পরিপূর্ণ মুসলাম তথা মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে অনুপম শিক্ষা ইসলামে রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা দর্শনে নেই। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবদি দুনিয়াতে কীভাবে চলবে, কী খাবে কী খাবে না, উঠা-বসা, আচার-আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, আত্মিক, সামষ্টিক, শিল্পকলা, চিত্রকলা, সাহিত্য চর্চা, আনন্দ-বিনোদন সবকিছুই রয়েছে ইসলামি সংস্কৃতিতে।
অন্যদিকে মানব মস্তিষ্ক প্রসূত, ইসলামি রীতি-নীতি বিরুদ্ধ, অকল্যাণকর যা মানুষকে মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা না দিয়ে নগ্নতা ও বেহায়াপনা কিংবা ধর্মহীনতার শিক্ষা দেয় তা-ই অপসংস্কৃতি। এক কথায় ইসলামি সংস্কৃতির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, এমন সব কর্মকাণ্ডই অপসংস্কৃতি ও বর্জনীয়। অথচ, আজ মুসলিম জাতি তার নিষ্কলুস ও কালজয়ী সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে আধুনিক সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিকে জীবনের অনুসঙ্গ বানিয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, যা সত্যিই দুঃখজনক, অপমানকর এবং ভয়ানক! আমরা যদি নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি মুসলিম হয়েও ইসলামি সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন। দেশের অধিকাংশ মুসলমান ইসলামকে একটি সাংস্কৃতিক বিধান হিসেবে জানে না। যার ফলে আধুনিক সংস্কৃতির নামে পরদেশি অপসংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি মনে করে কাছে টেনে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আদর্শহীন অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছে। একশ্রেণির স্বঘোষিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, পশ্চিমাদের দালাল, বিকৃত রুচির মানসিকতা সম্পন্ন লোক দেশে আধুনিক সংস্কৃতির নামে বিজাতীয়, অনৈসলামিক ও অপসংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে দেশের প্রচার মাধ্যমগুলো কাজে লাগিয়ে অপসংস্কৃতির প্রচার প্রসার করছে, যার কারণে আজকের সমাজে সাম্য, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমুসহিষ্ণুতা, আদব কায়দা, শিষ্টাচার ইত্যাদি লোপ পাচ্ছে।
বার্থ ডে, ম্যারেজ ডে, লাভ ডে, এপ্রিল ফুল, থার্টি ফাস্ট নাইট, হ্যালোইন ডে, বাংলা নববর্ষ, বিজয় মেলা, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন বিশেষ দিন ও অনুষ্ঠানসমূহে যেভাবে অপসংস্কৃতি তথা বিদেশি ও নগ্ন সংস্কৃতির ছড়াছড়ি থাকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বেশ ক’বছর যাবত দেখা যাচ্ছে ‘হোলি’ উৎসব, যা নিতান্তই ভিনধর্মী ও ভিনদেশি উৎসব। অথচ, মুসলমানের ছেলে-মেয়েরাও এই বেহায়াপনায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে আজ আমরা পাপাচার, কামাচার, যৌনাচার, অনাচার, ইভটিজিং, বর্বরতা, হঠকারিতা, ধর্ষণ, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি আর উচ্ছৃঙ্খলতায় জর্জরিত। সমাজে যারা অপসংস্কৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন অনাচার প্রতিষ্ঠা করে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে মহান আল্লাহ। কুরআনের সূরা নূরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যে সকল লোক চায় যে, ঈমানদার লোকদের সমাজে নিলর্জ্জতা বিস্তার লাভ করুক, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহই জানেন, তোমরা জানো না।’ অপরদিকে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিন প্রকার লোক আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত: ১) হারাম শরীফের পবিত্রতা বিনষ্টকারী, ২) ইসলামে বিজাতীয় রীতি-নীতির (সংস্কৃতির) প্রচলনকারী এবং ৩) কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যার প্রচেষ্টাকারী (বুখারী)।
ইসলামি সংস্কৃতির সার্থক রূপায়ক হলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। যাঁর পুরো জীবন হলো আল কুরআনের বাস্তব রূপ। তাই জীর্ণ কুঠিরে, ছিন্ন বস্ত্রে অর্ধভুক্ত অনাড়ম্বর মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব উপদ্বীপকে বিশ্ব শান্তির মডেলে পরিণত করেছিলেন, যা পৃথিবীর প্রলয়দিন পর্যন্ত অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা ক্বলম)। তাই আমাদেরকে ইসলামি সংস্কৃতির সূতিকাগার পবিত্র কুরআন ও প্রিয় নবীর জীবনাদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে প্রচলিত অপসংস্কৃতিকে নির্মূল করে সমাজে ইসলামি সংস্কৃতির স্রোতকে আরো গতিময় করতে হবে। ইসলামে এটা নেই, ওটা নেই বলে গলা ফাটালে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ হবে না। বরং ইসলামি সীমারেখার মধ্যে থেকে জীবনের জন্য উপাদেয়, আনন্দদায়ক, সার্বজনীন ও নিষ্কলুস সংস্কৃতি চর্চার বাস্তব দিকনির্দেশনা উপস্থাপন করতে হবে সাধারণের কাছে এবং প্রচলিত অপসংস্কৃতি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রত্যেকটি অনুসঙ্গ চিহ্নিত করে তার বিকল্প হিসেবে ইসলামি সংস্কৃতির রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। অন্যথায় অপসংস্কৃতির ভয়াল স্রোতকে দমানো সম্ভব হবে না। উদাহরণ স্বরূপ বাংলা নববর্ষ ও খ্রিস্টীয় নববর্ষের অপসংস্কৃতি থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে হিজরি নববর্ষ উদযাপন করতে হবে এবং তুলে ধরতে হবে নববর্ষের ইতিহাস, পালনীয়, বর্জনীয় ও ইসলামি ঐতিহ্য। যেমন ঈদে মিলাদুন্নবি, লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল নিছফ মিন শাবান (লাইলাতুল বরাত), শবে মেরাজ, আশুরা, সালাম, সাওম, যাকাত, ফিতরা ইত্যাদি ইসলামি সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে দ্বীনের পথে উজ্জ্বীবিত করে।
আসুন, তথাকথিত ধর্মহীন, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকে না বলি এবং ইসলামের শাশ্বত, কল্যাণকর ও সার্বজনীন সংস্কৃতিকে আলিঙ্গন করে সুস্থ ও সুন্দরের ছোঁয়ায় নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করি, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের রক্ষা করুন’ (সূরা বাকারা)।
লেখক: প্রাবন্ধিক
shadat_hussein@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন