বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও পুলিশ রিমান্ড প্রশ্নে আপিল বিভাগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারকদের প্রতি কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় আটক রাখার জন্য কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না। গ্রেফতার অভিযানকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। গ্রেফতারকৃত এবং উপস্থিত ব্যক্তিরা যদি পরিচয়পত্র দেখতে চান তাহলে তাদেরকে অবশ্যই তা দেখাতে হবে। গ্রেফতারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে ওই ব্যক্তির অত্মীয়-স্বজন অথবা বন্ধু-বান্ধবকে গ্রেফতারের সময় এবং স্থান জানাতে হবে। জারিকৃত নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, কেইস ডায়েরি ছাড়া কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দেবেন। সাড়ে ৫ মাসের মাথায় আপিল বিভাগ গত বৃহস্পতিবার ১৯ দফা নির্দেশনাসংবলিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারকদের প্রতি এ সংক্রান্ত নির্দেশনা সম্বলিত ৩৯৬ পৃষ্ঠার এই রায় লিখেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। রায়ে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবিলম্বে সব পুলিশ স্টেশনকে জানাতে আইজিপিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া র্যাব-এর মহাপরিচালককে এই নির্দেশনা তার ইউনিট ও অফিসারদের মাঝে প্রচার করতে বলা হয়েছে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মাঝে প্রচারের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য কর্তৃক সাধারণ মানুষের হয়রানি বন্ধ ও মৌলিক অধিকার রক্ষা সম্পর্কিত এ রায়কে আইনবিদরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা এ রায়কে যুগান্তকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক হয়রানি আতঙ্ক দূর এবং স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়। এটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলার উপর। আমরা দেখেছি, গত মে মাসে এ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর শুরুতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা মেনে চললেও কিছুদিন না যেতেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ড নেয়ার ক্ষেত্রে এ বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অনেকটা প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে। নির্বিচারে অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। এসব প্রক্রিয়া অবলম্বন করার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ সংবলিত উচ্চ আদালতের যে একটি রায় রয়েছে, তা প্রতিপালন দূরে থাক, উল্টো উপেক্ষা করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, যখন-তখন যে কাউকে উঠিয়ে নেয়া এবং রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক হিসেবে বিরাজ করছে। বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নির্যাতন ও মৃত্যুবরণের বহু নজির সৃষ্টি হওয়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রেফতার করার পর তা অস্বীকার করার বা গুম হওয়ার ঘটনা মানুষকে আরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। অতীতে এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ এবং মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে আইনবিদরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু বেড়েই চলেছে। গণতন্ত্রের সংকটকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব এবং অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের প্রবণতা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মুখ ফুটে ভুক্তভোগীদের কথা বলার সুযোগ নেই। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও রোষানলে পড়তে হয়। সর্বত্রই মানুষের মধ্যে এক ধরনের নীরব ভীতি কাজ করছে। আইনের শাসনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর। হয়রানি ও নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমাগত নেতিবাচক দিকে ধাবিত। মানুষ যদি স্বস্তিতে চলাফেরা এবং নিরাপত্তা বোধ না করে, তবে তাদের স্বাভাবিক কর্মকা- ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক সুব্যবস্থার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও চান এ বাহিনীর দুর্নাম ঘুচুক এবং শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। বিভিন্ন সময়ে তারা এ তাকিদ দিয়ে আসছেন। বাস্তবে তাদের এ তাড়নার প্রতিফলন খুব কম দেখা গেছে। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এ বাহিনীর বদনাম ঘুচিয়ে শৃঙ্খলার ভিত দৃঢ় করতে আদালতের নির্দেশনা সংবলিত রায় মেনে চলা অপরিহার্য। ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদালতের রায় উপেক্ষা করা হয়েছে। রায় বাস্তবায়নে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা তা পালন করেননি। এর ফলে অনিয়ম থেকেই গেছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেহেতু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত, তাই তাদের দ্বারা মানুষের নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটলে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। বলা বাহুল্য, চিহ্নিত অপরাধীদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভাল করেই চেনে। তাদের তালিকা ধরে গ্রেফতার করলে আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ উন্নত অবস্থায় থাকবে, সাধারণ মানুষও স্বস্তি পাবে। তা না করে, যদি সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হয়, তবে অপরাধীরা যেমন প্রশ্রয় পায়, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনতে আদালতের রায় যুগোপযোগী এবং তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি। আইন থাকলেই হবে না, তার প্রয়োগও করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আদালতের এ রায়কে আইনবিদ ও সাধারণ মানুষ যুগান্তকারী হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উচিত হবে এ সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তা নাহলে যারাই এর ব্যত্যয় ঘটাবে, তাদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন