আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই খাওয়া- দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে কী খাবে, কী খাবে না। আসলে সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা ইসলামের বিধান অনুযায়ী একই নিয়মে রোজা পালন করেন। বিভিন্ন দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং বিভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাই স্থান কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়ারও তারতম্য রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করব।
ঐতিহ্যগত ভাবে আমরা সেহরি ও ইফতারে যেসব খাবার গ্রহণ করি সেগুলোর সবই যে যথাযথ তা কিন্তু নয়। এসব খাবারের মধ্যে কিছু খাবার রয়েছে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আবার কিছু খাবার আছে যেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা পুষ্টিকর খাবার হলেও সময়োচিত নয়। রোজায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোজাদাররা অসুস্থ হয়ে পড়েন যথাযথ খাবার গ্রহণ না করার কারণে। রোজা পালনের জন্য প্রয়োজন সঠিক ডায়েট নির্বাচন, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শক্তি এবং অদম্য ইচ্ছা ও আনুগত্য। আর চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, কিছু নিয়ম নীতি ও পরামর্শ অনুসরণ করলে, কষ্ট ছাড়াই রোজা পালন করা যায়। রোজায় প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে আসে ভিন্নতা, তার সঙ্গে সময়ের ব্যবধানতো রয়েছেই। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে যে, রোজায় ১৪-১৫ ঘন্টা না খেয়ে থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তাই ইফতারে বেশি বেশি খাওয়া ভালো। আবার রোজায় রাত্রে খাবারের বিরতি কম হওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া হয়। আবার অনেকেই বলেন, রোজায় আল্লাহর কাছে খাবারের হিসাব দিতে হবে না। তাই রোজায় রকমারি খাবারের আয়োজন বেড়ে যায়, যা কিনা স্বাস্থ্য উপযোগী নয় । তবে দৈনিক চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখেই খাদ্য নির্বাচন করা দরকার।
সেহেরিতে কি খাবেন- রমজানে স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে হয়। সকালের নাস্তার পরিবর্তে খুব ভোরে সারাদিনের উপবাসের সময় চলার মতো খাওয়ার প্রয়োজন হয়। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য সেহেরি খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, সেহেরির খাবার মুখরোচক, সহজ পাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অধিক তেল, অধিক ঝাল, অধিক চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়। ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ অথবা মাংস খাবেন। অনেকেই মনে করেন যেহেতু সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে, তাই সেহেরির সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। তা মোটেই ঠিক নয়, কারণ চার পাঁচ ঘন্টা পার হলেই খাদ্যগুলো পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না খাওয়াই ভালো বরং মাত্রাতিরিক্ত খেলে ক্ষতির আশাঙ্কাই বেশি। পিপাসা নিবারণ হয়, সেই পরিমাণ পানি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পান করতে হবে। দীর্ঘ সময় অভূক্ত থাকার কারণে শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে এবং পানিশূন্যতার কারণে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইফতার থেকে সেহেরি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অন্তত দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করবেন। অনেকে পানির পরিবর্তে লেমন অথবা রোজ ওয়াটার, ফ্রুট ওয়াটার, নানা ধরনের শরবত, ভিটামিন ওয়াটাসহ নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত পানীয় পান করেন। আসলে রোজাদারদের শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। ইফতার ও সেহেরিতে চা কফি পরিহার করা বা কম পান করা ভালো।
রোজাদারদের প্রচুর সবুজ শাকসবজি, ফলমূল আহার করা উচিত। রমজান মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সহজেই তার স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারে, যদি ঠিক ডায়েট অনুসরণ করা হয়। কখনোই শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখবেন না। অতিভোজন থেকেও বিরত থাকুন। খাবার ভালো ভাবে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খান, যা আপনার হজমে সহায়ক হবে। ইফতার ও সেহেরি সময়ের মধ্যে অন্তত পক্ষে আট গ্লাস পানি পান করুন। গ্লাস গুনে পানি পান করতে অসুবিধা হলে, সম পরিমাণ পানি বোতলে ভরে রাখুন এবং ইফতার থেকে সেহেরি সময়ের মধ্যে তার পুুরোটা পান করুন। এনার্জি ড্রিংক,কার্বনেটেড ড্রিংক এবং সোডা জাতীয় পানীয়গুলো বর্জন করুন। এগুলো গ্যাস্ট্রিক এসিডিটি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের কারণেই অসুস্থতা দেখা দিয়ে থাকে। তাই সেহেরিতে সহজপাচ্য খাবার খান।
ইফতারিতে কী কী খাবেন- রমজান মাস এলে বিকালবেলা থেকেই ইফতারের জন্য নানা খাবার তৈরি ও বিক্রির হিড়িক পড়ে। হরেক রকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে, ফুটপাথে, অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে সাজিয়ে রাখে। এসব ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডালবড়া, সবজি বড়া, আলুর চপ, খোলা খেজুর, হালিম, জালি কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রঙ মিশ্রিত বাহারি শরবত। তাছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারিতো আছেই। প্রশ্ন হলো এসব মুখরোচক খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে কিনা। ভেজাল তেল, বেসন ও কৃত্রিম রঙ মেশানো হয়েছে কিনা, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। যে তেলে ভাজা হয়, সেই তেল একবারের বেশি ব্যবহার উচিত নয়। কারণ একই তেল বারবার আগুনে ফুটালে কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয়, যেমন পলি-নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন, যার মধ্যে বেনজাপাইরিন নামক ক্যান্সার হতে পারে এমন পদার্থের মাত্রা বেশি থাকে। তা ছাড়া অপরিষ্কারভাবে ইফতারি তৈরি করলে পেটের পীড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যত্রতত্র খোলা খাবার না খাওয়াই উচিত।
খুব কম ফলই পাওয়া যাবে, যা ভেজালমুক্ত। শরবতের কথাতো বলাই বাহুল্য। রাস্তা ঘাটে, হাটে বাজারে রমমারি শরবত তৈরি করা হয়। আমাদের জানতে হবে, এসব শরবত যে পানি দিয়ে বানানো হয়, সে পানি বিশুদ্ধ কিনা। তাছাড়া ইফতারের জন্য তৈরি প্রায় সব খাবার তেল ও উচ্চ চর্বিযুক্ত। সাধারণত এসব খাবার মানসম্মত তেলে এবং সঠিক নিয়মে ভাজা হয় না, তাই এসব স্বাস্থ্যসম্মত নয়। একজন রোজাদার ইফতারে কী খাবেন তা নির্ভর করবে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের ওপর। পারতপক্ষে দোকানের তৈরি ইফতারি ও সেহেরি না খাওয়াই ভালো। সুস্থ, স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য ইফতারিতে খেজুর বা খুরমা, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পেঁয়াজু, বুট, ফরমালিন অথবা ক্যালসিয়াম কার্বাইড মুক্ত মৌসুমি ফল থাকা ভালো। কারণ ফলে ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়। ফল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং সহজে তা হজম হয়। রুচি অনুযায়ী বাসার রান্না করা নুডুলসও খেতে পারেন। বেশি ভাজি ভুনা তেহারি, হালিম না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বদহজম হতে পারে।
রুচি পরিবর্তনের জন্য দু-একটা জিলাপি খেতে পারেন। তাছাড়া গ্রীষ্মকালীন রমজানে পরিমাণমতো বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। এশা ও তারাবির নামাজের পর অভ্যাস অনুযায়ী পরিমাণমতো ভাত, মাছ অথবা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খাবেন। ইফতারে বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ এবং সহজে ও তাড়াতাড়ি হজম হয় এমন খাদ্য গ্রহণ করুন।
মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক- কলামিস্ট।
মোবা: ০১৭১৬-২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন