ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম রমজান মাসের রোজা পালন করা মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। তাই মুসলমানরা মাসটির আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে দীর্ঘ ১১টি মাস। শাবান মাসের শবে-বরাত শেষ হবার সাথে সাথে রমজান মাসের আগমনের পদধ্বনি শুরু হয়ে যায় মুসলিম সমাজে এবং আনন্দের ঢেউ খেলতে থাকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম হৃদয়ে। যারা রমজানের মাসব্যাপী রোজা পালনে অভ্যস্ত তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। তারা রমজানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে এবং ইফতার, সেহরি ও তারাবীহর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
শাবানের ২৯ তারিখের বেলা শেষে রোজাপ্রেমিকরা পশ্চিমের আকাশে অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকে। ওই দিন চাঁদ দেখা গেলেই রোজা শুরু পরদিন। অনেক সময় চাঁদ দেখা যায় না। ফলে রোজা একদিন পিছিয়ে যায়। কেউ কেউ ভাবে ২৯-এ চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাস হবে ৩০ দিনে এবং রমজান শেষ হবে ২৯ দিনে। কেননা, চন্দ্রবর্ষের যে মাস ৩০ দিনে শেষ হয়, তার পরের মাস ২৯ দিনে শেষ হয়, এটাই সাধারণ নিয়ম। তাছাড়া আরবি হিসাব গণনাবিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, আরবি চন্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে অর্ধেক ৬ মাস হয় ৩০ দিনে এবং বাকি অর্ধেক ৬ মাস ২৯ দিনে, যা একটি হাদীসের মর্ম হতে উদ্ভাবিত। তারা এসব মাসের নামও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। উভয় শ্রেণির মাস স্মরণে রাখা হলে চাঁদের হিসাব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকে না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে এদেশের মুসলিম পরিবারগুলোর অনেকেই আরবি মাসগুলোর দুই একটি ব্যতীত অধিকাংশ মাসের নাম পর্যন্ত বলতে না পারলেও প্রয়োজনে ঘড়ি, মোবাইল, পঞ্জিকা, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার এবং পত্রপত্রিকা দেখে সঠিক দিন তারিখ বলে দেয়।
রমজানের ঈদের আগমনকে কেন্দ্র করে অতীতে যেসব বিতর্ক ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করত এবং আনন্দ-খুশি, নিরানন্দ-বিষাদে পরিণত হয়ে যেত, তার এখন অনেকটাই অবসান ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রমজানের ঈদের চাঁদ সউদী আরবে কখন দেখা গিয়েছে, এ খবর পর্যন্ত যথাসময়ে সংগ্রহ করা ছিল দুরূহ ব্যাপার। আর এখন মক্কা শরীফের জামাতে নামাজ, তারাবীহ, হজ্বের অনুষ্ঠানাদি, আরাফাতে ইমামের ভাষণ, কোরাবানি, তাওয়াফ, ইফতারের দৃশ্যাবলী ইত্যাদি সহজেই ঘরে বসে অবলোকন করা যায় এবং হারামাইন শরীফাইনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করা যায়।
বলছিলাম রমজানের আগমনকে খোশ আমদেদ, স্বাগতম জানানোর বিষয় সর্ম্পকে। পুরানো জামানার অনেক ধ্যান-ধারণা ও রীতি-নীতির অনেকটা পরিবর্তন হতে চলেছে। কবে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ইসলামি ঐতিহ্য-সংস্কৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। আগেকার যুগে বিশেষত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে রোজা ও ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে প্রায়ই লংকাকাণ্ড ঘটতো। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। চাঁদ দেখা, না দেখা নিয়ে আলেম সমাজে ফতোয়া চালাচালির প্রতিযোগিতা ছিল উপভোগ করার মতো। তখন টিভি না থাকলেও রেডিও’র খবর ছিল দারুণভাবে বিতর্কিত।
মহিমান্বিত রমজান মাস বছরে একবারই মুসলমানদের দ্বারে উপস্থিত হয়। আল্লাহর খাস বান্দাগণ এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে রমজানের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট তফাত দেখা যায়। রমজানকে সামনে রেখে বুর্জগানে দ্বীন বৈষয়িক বিষয়গুলো আগেভাগেই সেরে নেন এবং রমজান মাস উদযাপনের জন্য বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণের চেষ্টা করেন। তাদের দ্বীনি কর্মসূচিগুলোতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে , সেগুলো সুচারুরূপে সম্পাদনে তারা সর্বদা যত্নবান থাকেন।
সাধারণত জাতীয় ও সামাজিকভাবে রমজানকে স্বাগত জানাবার নানা উদ্যোগ আয়োজন গৃহীত হতে দেখা যায়। মসজিদগুলোর কর্তৃপক্ষ রমজান উপলক্ষে মসজিদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করে থাকেন। তারাবীহ নামাজের ইমাম-হাফেজ না থাকলে, তার ব্যবস্থা করা হয়। মসজিদে রোজাদার, নামাজীদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় লোকেরাও ইফতারের উদ্দেশ্যে নানা প্রকারের ইফতার সামগ্রী সরবারহ করে থাকে এবং মসজিদে তারাবীহ নামাজের জামাতে অনেকেই উপস্থিত হয়। বিভিন্ন মসজিদে ইতেকাফের ব্যবস্থাও করা হয়। অনেকে মসজিদে গিয়ে সময় কাটান। কোরআন তেলাওয়াত, অজীফা পাঠ এবং তসবীহ-তাহলীল ও বিভিন্ন এবাদতে কিছু সময় ব্যয় করে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কেউ কেউ রমজান উপলক্ষে মসজিদে দান-সদকা এবং কোরআন শরীফ দান করে। গ্রামীণ মসজিদগুলোতে লোকেরা ইফতারের জন্য মিষ্টি, হালুয়া, সিন্নী, খোরমা, চিড়া-মুড়ি, নারিকেল প্রভৃতি ছাড়াও নানা প্রকারের ইফতারি প্রেরণ করে থাকে। অনুরূপভাবে শহরের বড়-ছোট মসজিদগুলোতে ইফতারের আয়োজন দেখা যায়।
শহরে-নগরে রমজানকে স্বাগতম জানানোর অংশ হিসেবে নানা প্রকারের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইফতার উপলক্ষে নানা ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন-সংস্থার পক্ষ হতে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে সকল শ্রেণির লোক অংশগ্রহণ করে থাকে। সরকারি-বেসরকারি নানা শ্রেণির প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে ইফতার পার্টির আয়োজন করা রীতিমত প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। বিশেষভাবে শহর এলাকাগুলোতে বিপুল পরিমাণে ইফতারির প্যাকেট বিক্রি হয়, যেগুলো মিষ্টির দোকানগুলো হতে সরবরাহ করা হয়। এগুলো ছাড়াও শহরের সর্বত্র ইফতার মার্কেটের ছড়াছড়ি চোখে পড়ার মত। ঢাকার চকবাজার সারাদেশের সেরা ঐতিহ্যমন্ডিত মার্কেট হিসেবে ইতিহাস খ্যাত, এখানে ইফতারের রকমারি খাবার সংগ্রহের জন্য বহু দূর-দূরান্ত হতে মানুষদের সমাগম ঘটে। এখানে সর্বোৎকৃষ্ট দামী ইফতার সামগ্রী ছাড়াও সর্বপ্রকারের টাটকা ফল-ফলাদি পাওয়া যায়। চকবাজার ছাড়াও ঢাকা মহানগরীর সর্বত্র সড়ক-মহাসড়কে এমনকি অলিতে-গলিতে ইফতার সামগ্রীর দোকান বসে। এসব উদ্যোগ-আয়োজনের একমাত্র উদ্দেশ্য রোজদারগণের মধ্যে ইফতার সামগ্রী সহজলভ্য করা। রমজান মাসের রোজার প্রতি এসব উদ্যোগ-আয়োজনকে এক প্রকারের সম্মান প্রদর্শন বলা যেতে পারে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, রমজান মাসে মুসলমান রোজাদারগণের ইফতার সামগ্রীর ব্যবসা বহু পূর্বে শুরু হয়ে যায়। আরব ও বিশ্বের অন্যান্য দেশ হতে খোর্মা-খেজুর আমদানি হতে শুরু করে ছোলা, ডাল, তেল, চিনি প্রভৃতি আমদানি করা হয় এবং গুদামজাত করে রমজান উপলক্ষে খোলা বাজারে ছাড়া হয়। রমজান উপলক্ষে এ ধরনের আরো বহু প্রকারের আয়োজন লক্ষ করা যায়।
মুসলমানদের ঐতিহ্যমণ্ডিত গৌরবোজ্জ্বল ধর্মীয় মাস রমজানের সুপ্রভাব বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। দুনিয়ার যে প্রান্তেই মুসলমানের বাস, সেখানেই রমজান মাসের আগমনকে স্বাগতম জানানো হচ্ছে। মুসলমানদের ইফতার অনুষ্ঠানগুলোতে সানন্দে অমুসলিমরা পর্যন্ত অংশগ্রহণ করছে। ঐসব অনুষ্ঠানে যার যার রীতিপ্রথা অনুযায়ী নানা ধরনের বাহারী ইফতারের আয়োজন করা হয়। রমজান মাসের রোজা পালনের অনুভূতি দুনিয়ার সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইফতার, তারাবীহ, মসজিদে কোরআন তেলাওয়াতের এবং শিশু-কিশোরদের রমজানের পোশাক সজ্জিত দৃশ্যাবলী আধুনিক প্রচার মাধ্যমগুলোর বদৌলতে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, অনেক অমুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ও ব্যক্তিত্ব মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের রমজানের শুভেচ্ছা বাণী প্রেরণ করে থাকেন। এর মাধ্যমে মুসলমানদের রমজান মাস আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদার আসন লাভ করছে এবং ‘রমজান সংস্কৃতির’ বিস্তার ঘটছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন