মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
বছর ঘুরে পবিত্র রমজান মাস পুনরায় উপস্থিত। রমজান মাস গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ? এটা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাদিসে আছে। রমজান ও রোজা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা (সূরা বাকারা) ১৮৩ থেকে ১৮৭ নম্বর আয়াতে। কোরআন ও হাদীসের আলোকে, রমজানের গুরুত্ব সকলের পক্ষে সহজভাবে বোঝা সম্ভব নয় বিধায়, জ্ঞানী ব্যক্তিগণ আলোচনার মাধ্যমে সহজ ভাষায় এটাকে উপস্থাপন করছেন। রমজান মাসের গুরুত্ব টেলিভিশনগুলোর ইসলামী অনুষ্ঠানমালায় আলোচিত হচ্ছে। রমজান মাসের গুরুত্ব বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকায় সপ্তাহে একদিন ধর্ম বিষয়ক আলোচনার যেই পৃষ্ঠা প্রকাশিত হয়, সেখানে বিভিন্ন কলামে লেখা হচ্ছে। বিভিন্ন মসজিদেও এই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ শুক্রবার ১৯ মে ২০১৭ জুম্মার নামাজে আরবি ভাষায় খুতবার আগে, বাংলায় বক্তব্য রাখার সময়, ডিওএইচএস মহাখালী-র জামে মসজিদের সম্মানিত খতিব, হযরত মাওলানা সাদেকুল ইসলাম, রমজান মাসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। আলোচনা করাটাই সময় উপযোগী কাজ। কারণ আমাদের লেখাপড়ার পদ্ধতি সিলেবাস ইত্যাদি এমন হয়েছে যে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা ছাত্রগণ, দ্বীন-এর মূল্য, রমজানের গুরুত্ব ইত্যাদি, বিশেষায়িত বা স্পেশালাইজড সাবজেক্ট ব্যতিত, কোনো জায়গায় কোনো বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়ার জন্য পায় না। না পেলে ছাত্রগন জানবেন কীভাবে? অতএব টেলিভিশনের যৎকিঞ্চিত আলোচনা এবং পত্রিকার কলামের মাধ্যমে যৎকিঞ্চিত আলোচনায় সাধারণ মানুষের জন্য জানার একমাত্র না হলেও অন্যতম মাধ্যম। সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো জুম্মার নামাজের সময় প্রদত্ত খুতবা। শহরাঞ্চলে কম হলেও মফস্বল এলাকায় ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেই মাহফিলগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচিত হয়; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকভাবে নয়। যাহোক, রমজান মাস যে সকল কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে তিনটি কারণ মাত্র আমরা আলোচনা করছি।
প্রথম কারণ: কোরআন নাযিল
প্রথম কারণ, পবিত্র রমজান মাসে কোরআনুল কারিম নাযিল হয়েছে। কোরআনুল করিম হলো দুনিয়ার দৃষ্টিতে আরবি ভাষা। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে স্বীকৃত হবে যে, এই ভাষাতেই মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির সঙ্গে কথা বলেছেন। কোরআনুল করিম হলো মানব জাতির জন্য জীবন বিধান। কোরআনুল করিম হলো, মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া গ্রন্থগুলো তথা ঐশী কিতাবগুলোর মধ্যে সর্বশেষ। এই কিতাব প্রথম নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। এতে রমজানের সম্মান মর্যাদা এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এটি সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে বিবেচিত।
দ্বিতীয় কারণ: রোজা এবং তাকওয়া
এই মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। রোজা এমন একটি ইবাদত যার বিনিময়-পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সফল বা মকবুল রোজাদারকে নিজ হাতে তথা নিজ বিবেচনায় প্রদান করবেন। রমজান মাসে রোজা রাখা ছাড়াও অন্য সকল ইবাদত যথা নফল নামাজ, দান-খয়রাত, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির বিনিময়ে প্রদত্ত সওয়াব বহু গুণ বৃদ্ধি করা হয়, সাত গুণ বৃদ্ধি করা হয়, দশ গুণ বৃদ্ধি করা হয় এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে অন্তরের-পবিত্রতা বা আভ্যন্তরীণ-পবিত্রতা অর্জনে সহায়তা করা। অন্তরের-পবিত্রতা বা আভ্যন্তরীণ-পবিত্রতা অর্জনের যে পদ্ধতি, সেটিকে পবিত্র কোরআনে একটি শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়। সেই শব্দটি হলো তাকওয়া। তাকওয়াকে অনেকে বাংলায় ‘পরহেজগারী’ বলেও অনুবাদ করেন। তাকওয়া অর্জনের জন্য তথা পবিত্রতা অর্জনের জন্য, পবিত্র কোরআনে অনেকবার তাগাদা এসেছে। আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.) পৃথিবীতে আবির্ভাবের হাজার হাজার বছর আগে, নবী ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.) যখন আল্লাহর ঘর কাবার প্রাচীর রচনা করছিলেন তখন উভয়েই আল্লাহ তায়ালার কাছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মোনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন। তার একটি অংশ এখানে উদ্বৃত করছি। (পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা, আল-বাকারার আয়াত ১২৮-১২৯ দ্রষ্টব্য): “হে প্রভু, আমাদের উভয়কেই তোমার অনুগত বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ হতে এমন একটি জাতি উত্থিত করো যারা তোমার অনুগত হবে, আমাদিগকে তুমি তোমার ইবাদতের পন্থা বলে দাও এবং আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করো। হে প্রভু এদের প্রতি এদের জাতির মধ্য থেকেই এমন একজন রাসুল প্রেরণ করো যিনি তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তাদেরকে কিতাব এবং হিকমত শিক্ষা দান করবেন এবং তাদের বাস্তব-জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুষ্ঠুরূপে গড়বেন। তুমি নিশ্চয়ই বড় শক্তিমান ও বিজ্ঞ।” আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.) হলেন ওই প্রার্থীত নবী ও রাসুল। তিনি পবিত্র কোরআনের ভাষ্যকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তাকওয়া শব্দটি পবিত্র কোরআনে অন্তত পনেরোবার উচ্চারিত হয়েছে। নিম্নলিখিত আয়াতগুলো দ্রষ্টব্য। পবিত্র কোরআনের ৪৯ নম্বর সূরা, আল হুজুরাত, আয়াত-১৩, ৫৭ নম্বর সূরা, আল হাদীদ, আয়াত-২৮, ৬৫ নম্বর সূরা, আত্ তালাক, আয়াত-৪।
তাকওয়া শব্দের অতিরিক্ত আলোচনা
রমজানুল মোবারকে মানুষ যদি সতর্কতার সঙ্গে জীবন যাপন করে, তাহলে তাকওয়া অর্জনের পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়। তাকওয়া শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত; অধিক পরিচিত, পবিত্রতা বা পরহেজগারী বা খোদাভীতি শব্দের সঙ্গে। তাহলে তাকওয়া শব্দের অতিরিক্ত ব্যাখ্যা কী আছে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে, শারীরিক বা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জনের জন্যই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে চেষ্টা করি; যেই চেষ্টার নাম অযু করা। কিন্তু শারীরিক পবিত্রতা থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মনের বা চিন্তার পবিত্রতা। কারণ মন বা চিন্তাই মানুষের শরীরের কর্মকাÐকে নির্দেশিত করে। মন বা চিন্তার জগতের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই, চক্ষু বিভিন্ন দিকে দেখে, কান বিভিন্ন জিনিস শোনে, হাত বিভিন্ন জিনিস ধরে, পা বিভিন্ন দিকে অগ্রসর হয় ইত্যাদি। তাহলে নিয়ন্ত্রণকারী বা নিয়ন্ত্রনস্থল বা আদেশ প্রদান স্থল বা কমান্ড সেন্টার হলো মন। সেই মনকে পবিত্র করার প্রক্রিয়ার অংশ হলো রোজা রাখা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রোজার অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষ শুধু দুইটি জিনিসের উপর গুরুত্ব দেয়। একটি হলো নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার নিয়ন্ত্রণ, অপরটি হলো নির্দিষ্ট সময়ে পুরুষ ও স্ত্রীর বৈধ মিলন নিয়ন্ত্রণ। উভয় কাজটি শারীরিক কাজ। এই শারীরিক কাজগুলো কিন্তু তাকওয়া অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাকওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একটি সুপরিচিত উদাহরণ হচ্ছে এইরকম: আপনি সুতির কাপড় পড়ে একটি ফুলের বাগান দিয়ে হাঁটছেন। ফুলের বাগানের গাছগুলো ঘন ঘন লাগানো; বেশিরভাগ গাছ ও ফুল কাঁটাওয়ালা; মৃদুমন্দ বাতাস বইছে যেই বাতাসের কারণে আপনার কাপড় যেমন হালকাভাবে উড়ছে তেমনই ফুলগাছের কাঁটাওয়ালা ডালগুলোও মৃদুভাবে হেলছে ও দুলছে; বাগানের একপাশ থেকে অপরপাশে যাওয়ার জন্য চিহ্নিত যেই পথ সেটি অতি সরু; ওই সরু পথটির উভয় পাশ থেকে কাঁটাওয়ালা ফুলগাছের ডালাপালা এসে সরু পথটিকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে; এই সরু পথটিকে অনুসরণ করেই আপনাকে বাগানের অপর পাশে যেতে হবে; আপনি এমনভাবে বাগান পার হবেন যে, সুগন্ধিযুক্ত ফুল যেন আপনার গায়ে লাগতে পারে কিন্তু ফুলগাছের কাঁটা যেন আপনার কাপড়ে না লাগে। এটার নামই তাকওয়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যে, পৃথিবীর কাদামাটি পানি বাতাস আগুন জীবজন্তু বৃক্ষলতা সবকিছুর মধ্য দিয়েই এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যে, এগুলোর সুগন্ধিযুক্ত অংশ বা বৈধ অংশ বা পবিত্র অংশ আপনার জীবনকে ধন্য করতে পারে কিন্তু এগুলোর মন্দ বা দুর্গন্ধযুক্ত অংশ যেন আপনার জীবনকে কলুষিত করতে না পারে। অর্থাৎ সমাজে বসবাস করতে হবে: চোর-ডাকাত, ঘুষখোর-সুদখোর, সাধু-সন্ন্যাসী, নামাজী-বেনামাজী, ক্রেতা-বিক্রেতা, মহাজন-ঋণ গ্রহীতা, শিল্পপতি-শ্রমিক, মনোযোগী-অমনোযোগী ছাত্র, অধিনায়ক-সৈনিক, মন্ত্রী-মন্ত্রীর তোষামোদকারী, ইত্যাদি সকলের মধ্য থেকেও যেন নিজের চিন্তা ও আচরণকে কলুষমুক্ত রাখা যায়। এটার নাম তাকওয়া। তাকওয়া বা পবিত্রতা অর্জন শুধুমাত্র রমজানুল মোবারকের জন্য প্রযোজ্য নয়; সারা বছরের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এর প্রশিক্ষণের জন্য সর্বোত্তম সময় বিবেচিত হয়েছে নির্ধারিত হয়েছে পবিত্র রমজান মাস।
তৃতীয় কারণ: লাইলাতুল কদর
তৃতীয় কারণ, রমজানুল মোবারকের তৃতীয় দশকের বেজোড় রজনীগুলোতে লায়লাতুল কদর তথা সম্মানিত রজনী আছে যেই রাতের মর্যাদা বা মান বা মূল্য এক হাজার মাস থেকে বেশি। রমজানুল মোবারক হচ্ছে হিজরী ক্যালেন্ডার মোতাবেক বছরের নবম মাস। যেই চন্দ্রবর্ষকে দ্বীন ইসলামের এবং ইসলামী কর্মকাÐের জন্য ব্যবহার করা হয় সেটাকে আমরা হিজরী বর্ষ বলি। মহানবী (সা.) যেই দিন মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করেছিলেন, সেদিন থেকে বছর গণনা শুরু। তবে মাসগুলোর নাম শত শত বা হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। হিজরী ক্যালেন্ডার মোতাবেক তারিখ গণনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সূর্যাস্তের পর মাগরিবের আজানের সাথে সাথে নতুন তারিখ শুরু হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের হিসাব মোতাবেক ৫ বা ৭ বা ৮ ঘণ্টা সময়, অর্থাৎ রাতের প্রথম ভাগ হিজরী হিসেবে নতুন তারিখ এবং খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার মোতাবেক পুরানো তারিখ। এইরূপ হিসাব করলে পৃথিবীর সকল স্থানে স্থানীয়ভাবে হিজরী ক্যালেন্ডার মোতাবেক রমজানের তারিখ গণণা শুরু হয়। বাংলাদেশে যখন রমজানের ২৬ তারিখ শুরু হলো তখন আমেরিকাতে রমজানের ২৫ তারিখ বা ২৭ তারিখ দিনের শুরু হতে পারে। রমজান মাসের শেষ দশকে, যে সকল বেজোড় রাত্রি আছে, তার মধ্যে যে কোনো একটি রাত্রি হচ্ছে লায়লাতুল কদরের রাত্রি। আমাদের দেশে অন্য পরিচিত শব্দটি হচ্ছে শবে কদর। আরবি ভাষায় লায়লুন মানে রাত, কদর মানে সম্মানিত। ফারসি ভাষায় শব মানে রাত অতএব লায়তাতুল কদর বা শব-এ কদর মানে সম্মানিত রাত্রি। এইরকম একটি রাতকে আল্লাহতায়ালা পবিত্র রমজান মাসে অন্তর্ভুক্ত করে, রমজানকে মহিমান্বিত করেছেন এবং বিশ্বাসী মানুষকে কৃতার্থ করেছেন। মানুষকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে এই রাত্রির সন্ধানে সতর্ক থাকতে ও পরিশ্রম করতে। মানুষকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে এই রাত্রি থেকে উপকার আদায় করে নিতে।
আমাদের দেশে রমজানের চিত্র
রমজানুল মোবারকে একটি পরিচিত চিত্র দেই। জুম্মার নামাজে স্বাভাবিক সময় থেকে বিশ-তিরিশ শতাংশ মানুষ বেশি হবে। রমজানুল মোবারকে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজগুলোতে মসজিদে নামাজির সংখ্যা স্বাভাবিক সময় থেকে বিশ-তিরিশ শতাংশ বেশি হবে। এশার নামাজে বিশ তিরিশ শতাংশ নয়, প্রায় দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি হবে। এশার নামাজের সাথে তারাবিহ-এর নামাজ থাকে। ওই নামাজের সময় মুসল্লীগণ মসজিদ ভরে ফেলেন। তারাবির নামাজের উপস্থিতি প্রথম পাঁচ-সাত দিন পর একটু একটু কমতে থাকে; দশ-বারো রোজার সময় এসে স্থিতিশীল হয় এবং কমা বন্ধ হয়। আবার তেইশ-চব্বিশ রোজা থেকে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মসজিদে সাতাশটি তারাবির মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের খতম হয় যাকে বলা হয় খতম তারাবিহ। কিছু কিছু মসজিদে দশটি তারাবির মাধ্যমে খতম হয়; কিছু কিছু মসজিদে পনেরোটি তারাবির মাধ্যমে খতম হয়। বেশিরভাগ মসজিদে দুইজন কোরআনে হাফেজ তারাবির নামাজের নেতৃত্ব দেন; অতি অল্প সংখ্যক মসজিদে একজন হাফেজ দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করা হয়। রমজান মাস ব্যাপী সেহরীর আগে-পরে তিরিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা এবং ইফতারের আগে আগে পনেরো থেকে তিরিশ মিনিট বিভিন্ন প্রকারের ইসলামী অনুষ্ঠানমালা অনুষ্ঠিত হয়। মাথায় কাপড় দেওয়া মুসলমান মহিলাদের জন্য প্রয়োজনীয় রেওয়াজ হলেও এটা ব্যাপকভাবে অবহেলিত কিন্তু রমজান মাসব্যাপী, কিছু কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে, সংবাদ ও অনুষ্ঠান উপস্থাপিকাগণ মাথায় কাপড় দিয়ে পোশাক পরেন। রমজান মাসব্যাপী বাড়িতে বাড়িতে, মহল্লায় মহল্লায়, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনদের নিয়ে ইফতারির দাওয়াত আয়োজন করা হবে। গরিব মানুষকে ইফতার খাওয়ানো হবে। মসজিদে মসজিদে বিনামূল্যে মুসল্লিদেরকে এবং গরিব মানুষকে ইফতার খাওয়ানো হবে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রচুর টাকা খরচ করে, চাকচিক্যময়ভাবে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করবেন। আর কী হবে রমজান মাসে? সারা মাসব্যাপী দিনে এবং রাতে, মানুষ বাজারে থাকবে, বিপনী বিতানে থাকবে ঈদের বাজার করার জন্য। ঈদের বাজার মানে খাওয়া-দাওয়ার বাজার, পোশাক আশাকের বাজার। বাজারে থাকার কারণে বিপনী বিতানে থাকার কারণে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নামাজ কাযা হবে এবং ওই নামাজ আর পড়া হবে না। গরমের দিনে দিনেরবেলা বাজারে থাকার কারণে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে যাবে অতএব রাতে অতিরিক্ত কোনো ইবাদত হয়ে উঠবে না। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। ব্যবসায়ীগণ চালাক। ঘোষণা দিয়ে রমজানের ১ তারিখ থেকে কোনো জিনিসের দাম বাড়ান না। যেমন এই বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে রমজান আসার বিশ-পঁচিশ বা দশ-বারোদিন আগে থেকেই খাদ্য দ্রব্যের বিভিন্ন আইটেমের দাম বাড়া শুরু হয়েছে; সকল জ্ঞানী বিশ্লেষকগণের বিশ্লেণকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে। মূল্য বৃদ্ধির কোনো যুক্তসঙ্গত কারণ কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। পবিত্রতা অর্জনের মাসে, ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের পকেট থেকে বেশি টাকা আদায় করা হবে। এবং যারা আদায় করবেন তারা দেখতে শুনতে অত্যন্ত ভদ্র এবং সকলের নিকট সুপরিচিত পরহেজগার ব্যক্তি। মানুষকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য, সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপ প্রায় শূন্যের কোঠায় থাকবে। তারাবির নামাজ পড়ার পর মোবাইল ফোনে একজন ব্যবসায়ী তার আড়তে বা গুদামে সংবাদ দিবেন আগামীকাল কতটুকু মূল্য বাড়াবেন বা কী নিয়মে দ্রব্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবেন। রমজানুল মোবারকে ঘুষ খাওয়া কোনোমতেই কমবে না; অভিনব পদ্ধতিতে ঘুষ খাওয়া হবে। একজন ব্যক্তি আরেকজনের বাড়িতে প্রচুর ইফতারি পৌঁছাবেন। রমজান মাসের পনেরো তারিখের পর থেকে যাকাত বিতরণ শুরু হবে। আমাদের দেশে এখনও বেশিরভাগ মানুষ যাকাত বিতরণের নামে শুধুমাত্র কাপড় বিতরণ করে। কাপড়গুলোর নাম হচ্ছে যাকাতের কাপড়! অর্থাৎ অতি সস্তা কাপড় অর্থাৎ নিম্নমানের কাপড়। চুপেচাপে প্রচারণা ব্যতিত যাকাত দেওয়া হবে না; যাকাত বিতরণের ঘটনায় মানুষ পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা যাবে।
বদরের যুদ্ধের প্রসঙ্গ
ইসলামের ইতিহাসে অনেকগুলো যুদ্ধ আছে। প্রথম যুদ্ধটি আমাদের নিকট বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাংলা ভাষায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে সংঘটিত যুদ্ধগুলো সম্বন্ধে অনেক বেশি পুস্তক নেই। একটি পুস্তকের নাম ‘ব্যটেলস অফ ইসলাম’। নামের শব্দগুলো ইংরেজি হলেও বইটি বাংলায়; বইয়ের নামের বাংলা মানে হলো ইসলামের যুদ্ধগুলো। লেখক: মেজর জেনারেলর (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। প্রকাশক: অনন্যা। পুস্তকটিতে ইসলামের ইতিহাসের ১৩টি যথা বদরের যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্পেইন বিজয় পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে। রমজান মাসের ১৭ তারিখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আজকে এই কলাম যারা পড়ছেন তারা মেহেরবানী করে বদরের যুদ্ধ সম্বন্ধে চিন্তা করবেন; বদরের যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের কথা চিন্তা করবেন এবং বদরের যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে চিন্তা করবেন; আলোচনা করবেন। মহান আল্লাহর সম্মতিতেই বদরের যুদ্ধ রমজানুল মোবারকের একটি দিনে সংঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধটি ছিল অনেক বড় একটি ইবাদত।
উসংহার
সম্মানিত পাঠক, আমার কলাম শেষ পর্যায়ে। কলামটি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করলে এর তিনটি অংশ পাবেন। প্রথম অংশ হচ্ছে রমজান মাসের গুরুত্ব কী এবং আমাদের আচরণ কীরকম হওয়া উচিত। দ্বিতীয় অংশ, তুলনায় ছোট অংশ, হচ্ছে রমজান মাসে বাংলাদেশে যা হয় তার একটি চিত্র। পাঠক নিজেই মেহেরবানী করে কষ্ট করুন এবং মিলিয়ে নিন কোনটি সঠিক এবং কোনটি বেঠিক। তৃতীয় অংশটি হচ্ছে ক্ষুদ্রতম অংশ: বদরের যুদ্ধের আলোচনা। সর্বশেষ আবেদন রাখবো, রমজান মাস যদি একটি ফলদায়ক বৃক্ষ হয়, আমরা যেন সেই বৃক্ষ থেকে সর্বাধিক ফল আহরণ করতে পারি সেই চেষ্টাই হওয়া উচিত।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন