সারা দেশের সাথে বরিশাল কৃষি অঞ্চলেও বোরো আবাদে সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টির পরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন মাইল ফলক রচনার লক্ষ্যে মাঠে কৃষি যোদ্ধাগণ। তবে মৌসুমের শুরুতে ডিজেলের মূল্য ২৩% বৃদ্ধির ফলে এবার উৎপাদন ব্যায় ৯শ’ টাকা অতিক্রম করার আশংকার কথা জানিয়ে বোরো ধানের দাম মনপ্রতি নুন্যতম ১১শ’ টাকা না পেলে ভাগ্য বিপর্যয় শংকার কথাও জানিয়েছেন কৃষি যোদ্ধাগণ। এতেকরে আগামীতে দেশের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল বোরা আবাদে কৃষকের আগ্রহে ভাটা পড়ার শংকার কথাও জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়েরই একাধিক মহল।
এমনকি নদীবহুল বাংলাদেশেই এখনো সারা বিশ্বের মধ্যে সেচব্যায় সর্বাধিক, ২৮-৩০%। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের মরুময় পাঞ্জাবে সেচব্যায় মোট উৎপাদন ব্যয়ের মাত্র ১৩%। যা থাইল্যান্ডে ৮% ও ভিয়েতনামে মাত্র ৬%। উপরন্তু এবার ডিজেলের মূল্য ২৩% বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে সেচ ব্যায় প্রায় ৩০ %-এর ওপরে পৌছার আশংকা কৃষিবীদদের। উপরন্তু দেশে সেচকাজে বিদ্যুৎ বিলের ওপর সরকার ২৫% ভর্তূকি দিলেও অধিক ব্যয়ের ডিজেলের ক্ষেত্রে তা এখনো অনুপস্থিত।
চলতি রবি মৌসুমে দেশে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৬শ’ হেক্টরে আবাদের মাধ্যমে ২ কোটি ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরিতে ১৫ মার্চ চূড়ান্ত সমাপনী দিনে দেশে ৪৯ লাখ ৯ হাজার হেক্টরে বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ডিএই সূত্রে জানা গেছে। এরমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৮৫ হেক্টরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫০ হেক্টরে বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার ১১৩ ভাগ এবং বৃহত্বর ফরিদপুরের ৫ জেলায় ১০২% জমিতে বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় যে ১৫ লাখ ২২ হাজার ৫২০ টন বোরো চাল পাবার লক্ষ রয়েছে, তা ১৬ লাখ টনে পৌঁছবে বলে আশা করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ।
তবে দক্ষিণাঞ্চলে এখনো হাইব্রীড জাতের ধানের আবাদ কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। সারা দেশে এবার ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৭শ’ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৩ লাখ ২২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে হাইব্রিড জাতের বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় অতি উচ্চ ফলনশীল এ জাতের ধানের আবাদের পরিমান ৬৬ হাজার হেক্টরেরও কম। আর বৃহত্বর ফরিদপুরে আবাদ হয়েছে ৭২ হাজার ৪৮৩ হেক্টরে।
এমনকি প্রায় ৮লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে হাইব্রীড জাতের ধানের আবাদ আরো ১০ ভাগ বৃদ্ধি করতে পারলে, এঅঞ্চলে ১০ লক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্তের লক্ষ্যে পৌঁছান সম্ভব বলেও কৃষিবীদগণ মনে করছেন।
গত বছর রবি মৌসুমে দেশের প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে প্রথমবারের মতো ২ কোটি ৮ লাখ টনেরও বেশি বোরো চাল উৎপাদন হয় বলে কৃষি মন্ত্রী দাবি করেছেন। চলতি বছরে দেশে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ৪৮.৭৩ লাখ হেক্টরের বিপরীতে আবাদ ৪৯ লাখ ৯ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে। ফলে সারা দেশে ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে তা ২ কোটি ১১ লাখ টনে পৌঁছানের ব্যাপারে আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ। যা দেশকে এযাবতকালের সর্বোচ্চ বোরো উৎপাদনে নিয়ে যেতে পারে। তবে এজন্য প্রকৃতি সদয় থাকার পূর্বশর্তের কথা জানিয়েছেন কৃষিবীদগণ। ইতোমধ্যে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি এলাকায় সেচ সংকটের খবরও আসছে। এমনকি সেচের পানির অভাবে বরেন্দ্র এলাকায় এক কৃষকের আত্মহননের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
অপরদিকে চলতি রবি মৌসুমের শুরুতেই তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক বোরো বীজতলা ‘কোল্ড ইনজুরীর’র কবলে পড়ে। দক্ষিণাঞ্চলে ধান পাকতে আরো দেড়মাস বাকি। ফলে কাল বৈশাখীর ছোবলের আশংকাও থেকে যাচ্ছে। তবে উত্তরাঞ্চলের কিছু স্থানে ইতোমধ্যে ধান পাকতে শুরু করেছে। কিছু স্থানে কর্তনও শুরু হয়েছে সিমিত আকারে। গত বছর রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে অতিরিক্ত প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হলেও এবার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ বৈরী আবহাওয়া অত্যন্ত স্পর্ষকাতর এ ধানের জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
বীজতলা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সাথে ডিজেলের মূল্যবদ্ধি এবার ইরি-বোরা আবাদকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করেছে বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ। ডিএই’র মতে, দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি জেলার যে সাড়ে ১০ লাখ কৃষক ইরি-বোরোর আবাদ করেন, তার সেচকাজে প্রায় ৬৫ হাজার সেচ পাম্প ব্যাবহ্রত হয়ে থাকে। যার মধ্যে মাত্র ৬ হাজারের মত বিদ্যুৎ চালিত। অবশিষ্ট ৬০ হাজারেরও বেশি পাম্প ডিজেল চালিত বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গত মৌসুমের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এখনো দক্ষিণাঞ্চলের বোরো সেচাবাদ প্রায় পুরোটাই ডিজেল নির্ভর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন