মাহে রমজান ইবাদতের বসন্তকাল হিসেবে খ্যাত। এ দেশের ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা এ মাসে রোজা ছাড়াও নানা ইবাদতে নিজেদের শামিল রাখে। নিত্যদিনের কাজকর্ম অফিস-আদালত, কৃষিকাজ, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি করেও তারা ইবাদতের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে। এ মাসের ইবাদতের ফল অন্যান্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি। মাহে রমজানে পূর্ববর্তী ১১ মাসের যাপিতজীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। ধর্মীয় আবহ, পরিবেশ, রীতি, খাদ্যগ্রহণ প্রথা, আচরণ, অনুসরণ প্রায় সর্বত্র ঘটে পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ মাসে বন্ধ থাকে। দীর্ঘ এক মাসের অবকাশে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মচর্চা ও ধর্মানুশীলনের একটা সুযোগ পায়। গত বছর করোনার প্রকোপ কমায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল, পরে অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল, পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাস্তবতার বিবেচনায় এবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু হয়নি। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথা জানিয়েছেন। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবর মতে, প্রাথমিক ও ইফতেদায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলবে ২০ রমজান পর্যন্ত। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলবে ২৪ রমজান পর্যন্ত। ২০ অথবা ২৫ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট সংসশয়। যারা শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক, তাদের বেশির ভাগই রোজা রাখবে। এ সময় রোজার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা কিংবা শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়া করা অত্যন্ত কঠিন। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করা কিংবা শিক্ষকদের পাঠদান করাও সহজ নয়। ফলে, যে সুফল বা লাভের কথা বলা হচ্ছে, তা খুব কমই পাওয়া যাবে।
এ বছর প্রচণ্ড গরম ও দাবদাহ চলছে। রাজধানীসহ শহরগুলোতে চলাফেরা করা অত্যন্ত কষ্টকর। তার ওপর নজিরবিহীন যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে রাস্তাঘাটে। রমজানে জনচলাচল ও পণ্য পরিবহন একটু বেশি হয়। পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বেচাকেনা তুলনামুলকভাবে বেশি হয়। রাস্তাঘাটে মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। এমতাবস্থায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে পরিবেশ-পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে তা অনুমানের অতীত নয়। জন ও যান চলাচলে বাধা, দুর্ভোগ ও অচলাবস্থা যেমন দেখা দেবে তেমনি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকবে না। ইতোমধ্যে এ নিয়ে সকলের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্পর্কে নানারকম মতামত প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিপক্ষে। অনেকের অভিমত, রমজানের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। বলা হচ্ছে, করোনাকারণে দু’বছর শিক্ষার অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষতি ও ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা দরকার। সত্য বটে, দু’বছর শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষতি একমাসে বা দু’মাসে পোষানো সম্ভব নয়। এ জন্য আরো বেশি সময় প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাধ্যমে ধীরে ধীরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে হবে। এক মাসের কম সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রেখে এতদিনের ক্ষতি পূরণ করা যাবে, এমন ‘উর্বর’ চিন্তার কোনো সুযোগ এখানে আছে বলে মনে হয় না। অনেকে মনে করেন, কোনো ধর্মীয় উপলক্ষ কেন্দ্র করে একমাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা বা রাখা কিছু লোকের হয়তো পছন্দ নয়। তারা কোনো না কোনো অজুহাত সৃষ্টি করে এই বন্ধ বাতিল করতে চায়। গত বছর ও এ বছর এ বন্ধ নিয়ে যে ব্যতিক্রম সৃষ্টির চেষ্টা, সেটা তাদেরই কারসাজি হতে পারে। বলা বাহুল্য, মাহে রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা আমাদের অধিকার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এর অন্যথা করা যাবে না।
রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে যত কথাই বলা হোক না কেন, তা ধোপে টিকবে না। এতদিন রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, তেমন প্রমাণ নেই। আর এই একমাস খোলা রাখলেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মহা-উপকার হয়ে যাবে এমনটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ধর্মীয় দিক ছাড়াও রমজান মাসের আরো অনেক দিক আছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। রমজানকে উপলক্ষ করে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে, মালামাল পরিবহনের জোয়ার তৈরি হয়। এই সময় সবকিছু সচল ও গতিশীল রাখা আবশ্যক ও অপরিহার্য। কোনো দুর্ঘটে কিংবা যানজটে যদি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তবে অর্থনীতির ক্ষতি অনিবার্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানীর যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। জ্বালানিতে প্রতি মাসে ক্ষতি হয় ২২৭ কোটি টাকা। এমনিতে গরম, তার ওপর যানজট দীর্ঘায়িত হলে মানুষের দুর্ভোগও চরম সীমায় ওঠা স্বাভাবিক। আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে জনদুর্ভোগ ও যানজট বাড়বে। এতে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির যে ক্ষতির আশংকা, তা পূরণ হওয়া অসম্ভব। কাজেই অর্থনৈতিক স্বার্থেও যাতায়াত ব্যবস্থা সচল ও মসৃণ রাখা আবশ্যক। এ জন্য রাস্তাঘাটে জনচাপ ও যানজট কমাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা জরুরি। সবদিকের বিবেচনায়, অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হবে বলে আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন