শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

বরেন্দ্র অঞ্চলে বিরাজ করছে বৈরী আবহাওয়া

রেজাউল করিম রাজু | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০২২, ১:৪৩ পিএম

বরেন্দ্র অঞ্চলে বিরাজ করছে বৈরী আবহাওয়া। চৈত্র জুড়ে রোদ্রের দাপট চলছে। প্রায় চার মাস ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। পানির একমাত্র উৎস ভ‚-গর্ভের পানির স্তরও শংকাজনক ভাবে নামছে। এদিকে ফসল বাঁচাতে আর নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য নীচ থেকে পানি উঠানো হচ্ছে নির্বিচারে। কোথাও কোথাও টান ধরেছে। পানি উঠছেনা গভীর নলকুপেও।

তাপমাত্রার কাঁটা উপরের দিকে উঠছে ৩৫/৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে উঠা নামা করছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেচের চাহিদা বেড়েছে। এখন মাঠ ভরা বোরো ধানের আবাদ। খরার কবল থেকে আবাদ বাঁচাতে সেচের পরিমান বেড়েছে। ফলে বেড়েছে আবাদের খরচ।
এ অঞ্চলের আরেকটি অন্যতম ফল আম। প্রচন্ড খরতাপে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগা, নাটোরজুড়ে রয়েছে আমের বাগান। এবার শুরুতে গাছে গাছে ভাল মুকুল এলেও বৈরী আবহাওয়ার কারনে কাংখিত গুটি মেলেনি। যা এসেছে তা খরতাপ সহ্য করতে না পেরে ঝরে পড়ছে। এখন গুটি বাঁচাতে আম বাগানেও সেচ দিতে হচ্ছে।

চলতি বোরো মওসুমে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হচ্ছে। অন্যাদিকে আমের জমির পরিমানও বেড়েছে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগায়। এ অঞ্চলে আমের আবাদ হচ্ছে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আম বিশেষজ্ঞরা বলছেন এমনিতে এবার চল্লিশ শতাংশ গুটি এসেছে। টানা বৃষ্টিহীনতায় গুটি ঝরে যাচ্ছে।
আবহাওয়া বিভাগের মতে প্রায় চার মাস ধরে রাজশাহীতে প্রায় বৃষ্টি নেই। ভারী বৃষ্টি ও ঝড় হয়েছিল নভেম্বর মাসে। এরপর বৃষ্টি হয়েছিল ২৫ ফেব্রæয়ারী মাত্র চার মিলিমিটার। গত মার্চের পুরোটাই গেছে বৃষ্টিহীন। এবার ফাল্গুন থেকেই আবহাওয়ায় আগুন ঝরতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের প্রকৃতি আরো রুক্ষ হয়ে উঠেছে।

এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা আর্র্শীবাদ হলেও এখন ফারাক্কার কারনে মরে যাওয়ায় তা এখন অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা নদী খাল বিল দিঘীও মরে গেছে। ফলে পানির জন্য হাহাকার চলে বছরের সিংহভাগ সময়জুড়ে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আবহাওয়া রুক্ষ হতে রুক্ষতর হচ্ছে। নির্বিচারে নীচ থেকে পানি তোলা হলেও তা রিচার্জ হচ্ছে খুব কম। কমে গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমান। দেশের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান আড়াই হাজার মিলিমিটার হলেও এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান তেরশত মিলিমিটারের কম। পানি রির্চাজ না হওয়া আর নির্বিচারে পানি তোলার কারনে প্রতিবছর পানির স্তর নামছে। বৃষ্টিপাতে ভ‚-গর্ভস্ত পানির গড় পূন: ভরনের হার দেশে পচিশ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে এ হার মাত্র আট শতাংশ। বরেন্দ্রের উঁচু এলাকায় পানির সংকট প্রকট।

বরেন্দ্রের নথিপত্রে দেখা যায় ১৯৮০ সালে বরেন্দ্রে অঞ্চলে পানির স্তর ছিল ৪০ ফুট নীচে। আর ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নীচে নেমে যায়। এখন কোথাও কোথাও একশো ষাট সত্তর ফুটের নীচে পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। পানি সংকটের কারনে আগে বরেন্দ্র অঞ্চলে আবাদ বলতে ছিল বৃষ্টি নির্ভর ফসল। বিস্তির্ন এলাকা ছিল অনাবাদী। ১৯৮৫-৮৬ সালে অনাবাদী এসব জমিকে সবুজে ভরিয়ে তোলার জন্য গভীর নলকুপ বসানো শুরু করে। অনাবাদী রুক্ষ জমি সবুজে ভরে ওঠে। তিন চার ফসল উপহার দিতে থাকে। কৃষকের কাছে আর্শীবাদ হয়ে দেখা দেয়। শুরুতে ২৫ থানা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও এর সুফল দেখে পুরো উত্তরাঞ্চল চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত ষোল জেলা নিয়ে শুরু হয় বিশাল কর্মকান্ড। দেশের খাদ্য ভান্ডারে যোগ হয় বিপুল পরিমান নানামুখী ফসল। বিশেষ করে ধান আবাদের প্রয়োজনে প্রকল্প বিস্তার লাভ করে উত্তরের ষোল জেলায়। শুধু সেচ নয় অন্যান্য কর্মকান্ড যুক্ত হয় প্রকল্পে। ঠা ঠা বরেন্দ্রে সবুজতা, খাদ্য চলাচল রাস্তা, খাবার পানি সরবরাহসহ নানা প্রকল্প নিয়ে সমন্বিত বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প কাজ শুরু হয়। উত্তরের জেলাগুলোয় আঠারো হাজারের মত গভীর নলক‚প দিয়ে সেচ ব্যবহার গড়ে ওঠে। শুধু বরেন্দ্র প্রকল্প নয় ব্যাক্তি মালিকানায় পাম্প বসিয়ে শুরু হয় পানি তোলা। এমনকি সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে চলে নীচ থেকে পানি তোলা। ক্রমাগত পানি তোলা আর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে রিচার্জ না হওয়ায় পানির স্তর ক্রমশ: নীচে নামতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১২ সালের জুন মাস থেকে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে গভীরনলকুপ বসানো বন্ধ করে দেয়। তারপরও এখনো প্রকল্প এলাকায় পনের হাজার গভীর নলক‚প দিয়ে সেচ ব্যবস্থপনা চলছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদের কথা হলো আবাদ করতে হলে সেচ ব্যবস্থাপনা লাগবে। নীচ থেকে পানি উঠাতে হবে। বৃষ্টির অভাবে রিচার্জ হচ্ছে কম। ফলে স্তর নামছে। আমরা সেচ কম লাগে এমন ফসল আবাদের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করছি। বরেন্দ্রের কিছু এলাকায় পানি না পাওয়ার চিত্রটি পুরো বরেন্দ্র এলাকার নয়। তাছাড়া বরেন্দ্র প্রকল্প ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় পাম্প বসিয়ে পানি তুলে নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚-তত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল যিনি দীর্ঘদিন ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। জাতীয় পানি নীতিমালা কমিশনের অন্যতম সদস্য। আলাপকালে বলেন এ অঞ্চলে যেভাবে পানি তোলা হচ্ছে তা উদ্বেগজনক। বরেন্দ্র সেচের জন্য পানি তোলা ছাড়াও বিভিন্ন ভাবে পানি তোলা হচ্ছে। এমনকি সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি ওঠানো হচ্ছে। ফলে নীচের পানি দ্রæত কমছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় যে হারে পানি তোলা হচ্ছে তার খুব সামান্য রিচার্জ হচ্ছে। নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি এ্যাড. এনামুল হক বলেন ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রধান নদী পদ্মাকে মেরে ফেলেছে। যার ফলে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। সর্বত্র বিরুপ প্রভাব বিরাজ করছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন