বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘গ্লোবাল শোপার্স সার্ভে-২০১৬’ নামে পরিচালিত জরিপে বিশ্বের ১৮৭টি দেশের ২৬ হাজার ৬১৫ জন তরুণ অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ছিল ৬৭২ জন। ওই জরিপের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশী তরুণরা জানিয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, যার সেভাবে প্রতিকার নেই। তারা আরো বলেছে, সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কম। নেই কোনো রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সুরক্ষা ও নাগরিক-নিরাপত্তার ঘাটতিও যথেষ্ট। কেউ হয়তো বলতে পারেন, কয়েকশ’ তরুণের এই অভিমত বাংলাদেশের সব তরুণের অভিমতের প্রতিনিধিত্ব করে না। যুক্তির দিক থেকে কথাটি বেঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতার বিবেচনায় তাদের অভিমতের সত্যতা অস্বীকার করা যাবে না। বরং এও হয়তো বলা যাবে, দুর্নীতি, সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে তারা যা বলেছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। দুর্নীতি যে আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা এবং তা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত তা সবারই জানা। দুর্নীতি নিরোধে তেমন কোনো সাফল্য নেই। এর প্রমাণ দুর্নীতি বাড়ছেই। এ যাবৎ অনেক বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। কিন্তু একটিরও বিচার হয়নি। সব দুর্নীতির ঘটনাই চাপা পড়ে গেছে। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের কথা বলেছে, দ্রুত প্রতিকারের তাকিদ দিয়েছে। অথচ কাজের কাজ কিছু হয়নি। দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি জনগণের অনেক আশা-ভরসা। সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। এমনকি দুর্নীতিদমন কমিশনের কর্মকর্তাদের একাংশ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত- এরূপ অভিযোগও নতুন নয়। তাহলে দুর্নীতি কিভাবে কমবে বা নিরোধ হবে ?
একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এ কথা কারো অজানা নেই। এ ধরনের একটি সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা তাই অস্বাভাবিক নয়। সুশাসন বা আইনের শাসনের ঘাটতি উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের সুশাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে। সুশাসন না থাকলে নিরাপত্তাসহ কোনো ক্ষেত্রেই বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হতে পারে না। সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-দলনে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক ধারা অনেক আগে থেকেই রুদ্ধ। এমতাবস্থায়, মানুষের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তার কোনো অবধি নেই। স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ সরকারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে। যারা সরকারে আছেন, তারা এই বিষয়টি হয় বুঝতে অক্ষম, না হয় বুঝেও বুঝতে চান না। গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকারই আইনের শাসন ও নাগরিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশী নিশ্চিত করতে পারে। রাজনীতি উন্মুক্ত করতে হবে, গণতান্ত্রিক ধারা বেগবান করতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সরকারের যাবতীয় কর্মকা- জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবেÑ এটি সাধারণ দাবি। এদিকে সরকার ও রাজনীতিবিদদের নজর আছে, সেটা বলার উপায় নেই। নিরাপত্তা ও আইনী প্রতিকার পাওয়ার অভাব থাকলে নাগরিকদের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি যেমন থাকে না, তেমনি উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ইত্যাদি কোনো কিছুই ঠিকমত হতে পারে না। বাংলাদেশের তরুণরা বাস্তবতা দৃষ্টে হতাশ। তাদের ৭৬ শতাংশ বলেছে, তারা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে সবচেয়ে বেশী হতাশ। তারা রাজনীতিকদের স্বচ্ছতা, সততা ও আন্তরিকতার অভাব দেখেও হতাশ। বুঝাই যায়, তারা এ সবের অবসান চায়। কিভাবে অবসান সম্ভব, সেটা রাজনীতিকদের বের করতে হবে। কারণ, সব কিছুর ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
তরুণরা যা বলেছে, তা যেহেতু অস্বীকার করার উপায় নেই, কাজেই দুর্নীতি নিরোধ, সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আমাদের দেশের তরুণরা সব সময়ই অগ্রসর চিন্তার অধিকারী এবং জনগণের সবচেয়ে সচেতন অংশ। তারাই জাতির ভবিষ্যত। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে আগামীতে তারাই নেতৃত্ব দেবে। তাদের হতাশা থেকে মুক্ত করা আমাদের দায়িত্ব। তাদের অভিমতকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহ তরুণদের অভিমতকে প্রাধান্যে রেখে যথাযথ উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন