বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

উদ্বেগজনক ডায়রিয়া পরিস্থিতি

আইসিডিডিআরবি’তে ঠাঁই নেই বিভাগীয় শহর ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

রাজধানীর বেশ কিছু এলাকাসহ সারা দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। প্রায় দুই সাপ্তাহ থেকে ঢাকার আইসিডিডিআরবিতে প্রতিদিন ১২শ থেকে ১৫শ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে চাঁদপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কুডিগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, চ্ট্গ্রামসহ বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীর ভর্তির সংখা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত দেশে সাধারণত গরমকালে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু এবার একটু আগেভাগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাস থেকেই বিভিন্ন এলাকায় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে পানিবাহিত এ রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশেই। হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন, বাতাসে আর্দ্রতার আধিক্য, বৃষ্টি না হওয়া, ভ্যাপসা গরম, বিশুদ্ধ পানির অভাব ইত্যাদি কারণেই কমছে না ডায়রিয়ার প্রকোপ। চলমান সংক্রমণে রাজধানীতেই আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। তবে দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশুদ্ধ পানি পান না করা, তাপমাত্রার প্রভাবের পাশপাশি ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স হওয়ায় জটিলতা বেড়েছে।

এদিকে ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার রোগীরা চিকিৎসা নিতে ভিড় করছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডায়রিয়া পরিস্থিতি খানিকটা উদ্বেগ তৈরি করলেও আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া চিকিৎসকদের আশা, মে মাসের দিকে কমতে পারে, ডায়রিয়ার প্রকোপ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র প্রফেসর ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার কয়েকটি এলাকায় অনেক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী আসছে। এদের অনেকে ভর্তি হচ্ছেন। তবে যেসব রোগী আসছেন, তাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আইসিডিডিআর’বিসহ সব সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত শয্যাসহ খাবার স্যালাইন, ওষুধ এবং অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট মজুত রয়েছে।

সরেজমিন গতকাল বুধবার রাজধানীর আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। পুরো হাসপাতাল ডায়রিয়া রোগীতে পূর্ণ। প্রথম দিকে শিশুদের আধিক্য থাকলেও বর্তমানে এখানে আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই প্রাপ্তবয়স্ক।

আইসিডিডিআর’বি সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এদিন রোগী ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৪১ জন। হাসপাতালের শয্যার বাইরে ফ্লোরিং এবং তাবুতে রেখেও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এসব রোগীদের।

আইসিডিডিআর,বি দায়িত্বরতরা জানান, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকার মানুষ বেশি। এর পর দক্ষিণখান, বাসাবো, কদমতলী ও মোহাম্মদপুর এলাকার রোগী রয়েছে। এর বাইরে রাজধানীর সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরখান, উত্তরা ও রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকেও রোগী আসছে।

আইসিডিডিআর,বির হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, আগের বছরগুলোয় গরমের মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৭০০-৮০০ রোগী ভর্তি হতো। এবার রোগীর চাপ অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে রোগের জীবাণুর ধরন পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। তবে সেটি গবেষণা না করে বা নিশ্চিত না হয়ে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এবারের রোগীদের মধ্যে সিভিয়ার ডায়রিয়ার রোগী এবং কলেরায় আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদারায়ম গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত ২১ দিনে রাজধানীর কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৪৯ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ১৯২ জন শুধু মহাখালী কলেরা হাসপতালে ভর্তি হচ্ছেন। সেই হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৫০ রোগী হাসপাতালে আসছেন। এদের মধ্যে ২৩ শতাংশই কলেরায় আক্রান্ত, যা ইতোপূর্বে যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। তবে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, মাত্র ৭৯ জনের ওপর পরিচালিত একটি পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা যায় না যে, ডায়রিয়া আক্রান্তদের মধ্যে ২৩ শতাংশই কলেরা রোগী। এ ধরনের আংশিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিক্ষুণ হয়। এমনকি এ ধরনের আংশিক তথ্য পরিবেশনের ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে দুজনের। ঢাকা বিভাগে গত তিন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৬, চট্টগ্রামে ৫১ হাজার ৫৯৬, রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৬০৩, রংপুরে ৩৪ হাজার ৮১৯, খুলনায় ১ লাখ ১ হাজার ৮১৯, বরিশালে ১১ হাজার ৪০৩ এবং সিলেট বিভাগে ৩২ হাজার ৯৩৮ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে একজন লক্ষ্মীপুর এবং অন্যজন কক্সবাজারের বাসিন্দা।

ডায়রিয়া বৃদ্ধির কারণ কী- এমন প্রশ্নে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। একই সঙ্গে তীব্র গরম পড়ছে। তীব্র গরমে খাবারে দ্রুত জীবাণুর জন্ম দেয়। কোন সময়ের পর খাবার খাওয়া উচিত নয়, সেটি অধিকাংশ মানুষ জানে না। গরমের তীব্রতায় রাস্তাঘাটে তৈরি করা লেবুর শরবত পান ও পচাবাসি খাবার গ্রহণ করছে। এসব খাবার ডায়রিয়ার জীবাণুর অন্যতম উৎস। সবাই একসঙ্গে এসব খাবার গ্রহণ করছে এবং ডায়রিয়া রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে মানুষ নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে ছিল। ঘন ঘন হাত পরিস্কার করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রবণতা কমেছে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ, পরিবেশন ও খাবার খাওয়ার আগে হাত এবং টয়লেট থেকে বের হয়ে ও বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। কারণ, হাত দিয়ে মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে। এ ছাড়া ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে পানি। ঢাকার যেসব এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে, সেখানকার কলের পানিতে সমস্যা রয়েছে। ঢাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মূলত উৎসে পানির মান পরীক্ষা করে। কিন্তু অনেক এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে যায়। এটি সারাবছরের সমস্যা। এটি একটি চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। এখন তীব্র হচ্ছে।
ডায়রিয়া সংক্রমণ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেছেন, বিগত সময়ে ডায়রিয়া দেশে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ের ছিল। তবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স হওয়ায় সিভিয়ার রোগীদের সারিয়ে তুলতে সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে স্বাভাবিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কলেরার জীবাণুর ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দ্রুত এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন