মুসলিম সম্প্রদায়ের নিকট মাহে রমজান পবিত্র ও সিয়াম সাধনার মাস। মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক মুসলমানরা এই মাসে দীর্ঘ একমাস রোজা পালন করেন। দিনের বেলায় সবধরণের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তাই শরীরের সুস্থতার জন্য ইফতার, রাতের খাবার ও সাহরির সময় একটু সচেতন হয়ে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। রোজা রাখার ফলে নির্দিষ্ট একটা সময় শরীর সরাসরি খাবারের পুষ্টি উপাদান পায় না। এ সময়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গানুগুলো খাবার ছাড়া ভিন্ন ভাবে কাজ করতে থাকে। সারাদিন উপবাসের পর ইফতারের প্রথম খাবার গ্রহণের পর দেহের প্রত্যেক অঙ্গগুলো নিজ নিজ গতিতে কাজ শুরু করে। ফলে এ সময় শরীর বৃত্তীয় কাজ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য পরিমাণ মতো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। এদেশে গ্রীষ্ম কালের রোজায় নানা ফল শরীরের জন্য বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে। ইফতারের সময় টক মিষ্টি সব ধরণের ফল খান, সালাত তৈরী করে বা শরবত বানিয়ে খান। ফলে প্রায় সবধরণের পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। ফলের রস খুবই পুষ্টিকর পানীয়। যা অতি সহজেই শরীরে শক্তি উৎপন্ন করে। ফল অতি সহজেই হজম হয় এবং মুখের রুচি বাড়ায়। ফলের চিনি শরীরকে তরতাজা রাখে। ফলে থাকে শর্করা, প্রোটিন, লৌহ, ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি। নিম্নে কয়েকটি গ্রীষ্মকালীন ফলের কার্যকারিতা আলোচনা করা হলো-
খেজুর: খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। খেজুর রোজাদারের জন্য খুবই উপযুক্ত খাবার। কারণ সারা দিন উপবাস থাকার ফলে শরীরে যে ক্যালরির ঘাটতি দেখা দেয় খেজুর খেলে তা অল্প সময়ের মধ্যে পূরণ করে দিতে পারে। খেজুর অতি সহজেই হম হয় এবং দেহে দ্রুত শক্তি উৎপন্ন করে। খেজুরে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান আয়রণ, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, শর্করা, প্রোটিন পাওয়া যায়। খেজুর শরীরিক দুর্বলতা রোধ করে দেহের অবসাদ দূর করে।
তরমুজঃ- সারাদিন রোজা রাখার ফলে গরমের কারনে দেহে প্রচুর পানির অভাব দেখা দেয় তরমুজ হলো পানি জাতিয় ফল। ইফতারের তরমুজের শরবত খেলে শরীরের সারাদিনের পানির ঘাটতি ও পুষ্টির চাহিদা পূরন হয়। তরমুজে প্রচুর পরিমান ভিটামনি এ, সি, বি-কমপ্লেক্স, আয়রন, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, নিটুলিন ও লাইকোপিন থাকে। এসব উপাদান ইফতারের সময় সেবনের ফলে দূর্বল শরীরের জন্য প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে কাজ করে। মানব দেহের রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখে। চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়ায়, ক্যান্সার পতিরোধ করে এবং তারণ্য বজায় রাখে। তরমুজের রসের সাথে জিরার গুঁড়া মিশিয়ে খেলে হৃদরোগে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
ডাবের পানিঃ- ইফতারের সময় ডাবের পানি খেলে সারাদিনের তৃষ্ণা রিবারন হয় এবং পুষ্টি চাহিদা পূরন হয়। এতে প্রচুর পরিমান সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়। উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়রিয়া, বমি, প্রস্রাবের সংক্রামন পতিরোধ করে ডাবের পানি। দেহের পানি শূন্যতা তাড়াতাড়ি পূরন করে। ডবের পানি অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ভাইরাল হিসাবে কাজ করে। ডায়রিয়া ও ঘন ঘন হলে ডাবের পানি খান খুবই উপকার হয়। ডাবের পানি দিয়ে ঔষধ খেলে তা শরীরে ভালো ভাবে শোষিত হয়। যারা কিডনি রোগে আক্রান্ত বা ডায়ালাইসিস রোগিরা ডাবের পানি খাবেন না।
আনারসঃ- টক-মিষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য আনারস একটি উল্লেখ যোগ্য ফল। আনারস অ্যান্টিরায়োটিক ও প্রদাহ বিরোধী পদার্থ, সর্দিজ্বর, শরীরের বিষ ব্যাথা ও শারীরিক দূর্বলতার জন্য এটি প্রকৃতিক ঔষধ। আনারসে প্রচুর পরিমাণে বিটামিন সি, বি-কমপ্লেক্স, ফলেট, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ও জিংক এবং ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া যায়। এ ফলের রস শরীরিক দূর্বলতা কাটিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে। এতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এনজাইম ব্রোমেলেইন থাকে যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। দেহের গ্রন্থিগুলোকে সতেজ ও সবল রাখে। থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ কমায়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। যাদের ঘন ঘন সর্দি কাশি হয় তাদের জন্য আনারস প্রাকৃতিক ঔষধ। তবে কোন গর্ভবতী মহিলারা আনারস খাবেন না।
পাকা কলাঃ- পাকা কলা পটাসিয়াম ও আয়রনের ভালো উৎস। এতে আরো থাকে ট্রিপটোফ্যান নামের এমাইনো এসিড। যা দেহে পরিবর্তিত হয়ে সেরোটোনিনে রুপান্তরিত হয়। এ উপাদানটি দেহের অস্থিরতা, বিষন্নতা, মানসিক চাপ ও হতাশা দূর করে। এতে আরো থাকে পেকটিন যা দেহের বর্জ পদার্থ বের করে দেয়। দেহের রক্ত শূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর করে। হাঁড়ের ক্ষয়রোগ ও উচ্চরক্তচাপ এবং স্নায়ুতন্ত্রের দূর্বলতা কমায়। ডায়রিয়া পতিরোধ করে। এটি সহজে হজম হয় এবং দেহের শক্তি বৃদ্ধি করে।
পাকা পেঁপেঃ- দেহের পুষ্টি উপাদান পূরনে পাকা পেঁপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকা পেঁপেতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, সি পাওয়া যায়। রাতকানা রোগ সর্দি কাশি পতিরোধ করে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। অন্ত্রের গোলযোগ ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দেহের রোগ পতিরোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। চর্মরোগ পতিরোধ করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে।
কমলা বা মাল্টাঃ- কমলা ও মাল্টার পুষ্টি গুনাগুন প্রায় একই রকম। খাদ্য উপাদানের প্রায় পুষ্টি গুনই এ দুটি ফলে পাওয়া যায়। তাই স্বাস্থ্য রক্ষায় ফল দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনের শারীরিক দুর্বলতা দূর করে এবং শক্তি উৎপন্ন করে ফল দুটি। এতে আছে বিটা-ক্যারোটিন যা দেহের কোষের ক্ষয়-ক্ষতি রোধ করে। এতে থাকা ক্যালসিয়াম, পটিশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, শরীরের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। দেহে ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। হাড় এবং দাঁত সুস্থ সবল রাখে। দেহের অবসাদ দূর করে। চামড়ার সজীবতা বজায় রাখে। রক্ত সঞ্চালন সুষ্ঠু ও সবল রাখে, সর্দি কাশি ও ভাইরাস ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। দেহে বার্ধ্যকের চাপ পড়তে দেয় না।
পেয়ারাঃ- পেয়ারা প্রচুর পরিমানে ভিটামনি এ এবং সি থাকে। দেশীয় ফলের মধ্যে আমলকি ছাড়া পেয়ারার মতো এতো বেশি পরিমান ভিটামিন সি অন্য কোন ফলে নেই। এতে আছে ক্যারোটিনয়েড এবং পরিফেনল নামক রাসায়নিক যৌগ। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধি করে কোন রোগ জীবানু দেহে বাসা বাধতে দেয় না। এতে প্রচুর পরিমান আশঁ থাকে যা দেহের কোলেস্টেরল ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে। পেয়রাতে ফ্লাভিনয়েড উপাদান থাকে যা দাতেঁর রোধ প্রতিরোধ করে। ক্যান্সার প্রতিরোধে পেয়ারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এতে আরো থাকে লিউকোসায়ানিডিন অ্যামরিটোসাইড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের রোগ জীবানুর সাথে লড়াই করে শরীর সুস্থ রাখে, এর ভিটামিন এ রাত কানা রোগ প্রতিরোধ করে।
বাঙ্গিঃ- বাঙ্গি আমাদের দেশীয় ফলের মধ্যে অন্যতম পুষ্টিকর ফল। বাঙ্গিতে প্রচুর পরিমান খাদ্য শক্তি রয়েছে। যা সারা দিনের উপবাসের খাদ্য শক্তির যোগান দেয়। এতে ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম আছে। বাঙ্গিতে বিটা-ক্যারোটিন, লিউটিন, জিয়াজ্যান্থিন নামক উপদান থাকে। যা শরীরের ফ্রি রেডিক্যালস বের করে দেয়। এতে দূষিত পদার্থ জমা হতে দেয় না। এতে হৃদরোগ ও বাতরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এ ফলটি আমাদের চোখের দৃষ্টি শক্তি প্রখর করে। দেহে ক্যান্সার কোষ সৃষ্টি হতে দেয় না। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে শরীরকে তরতাজা করে তোলে। এ ফলটি আলসার ও ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে এবং ফুসফুসের কার্যকারীতা বৃদ্ধি করে। কিডনির পাথর ও হাড়ের ক্ষয়রোগ প্রতিরোধ করে। তাই প্রতিদিন ইফতারের সময় এক গ্লাস বাঙ্গি সরবত পান করুন।
লেবুর শরবতঃ- লেবুতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে যা মানব শরীরের জন্য খুবই উপকারী। প্রতিদিন ইফতারের সময় লেবুর শরবত খেলে তৃষ্ণা নিবারনের সাথে দেহের পুষ্টির চাহিদা পূরন হয়। শারীরিক দূর্বলতা অতি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দেহের ট্রক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমতে দেয় না। ফলে দেহ অতিরিক্ত মোটা হওয়ার সুযোগ পায় না। সর্দি কাশি প্রতিরোধ করে। মুখের রুচি বৃদ্ধি পায়।
মো: জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থবিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন