গত কয়েকদিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন-খারাবি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করে কিংবা কুপিয়ে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। এসব হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। হত্যাকারিরা এতটাই বেপরোয়া ও নিষ্ঠুর যে অবলীলায় তা করে ফেলছে। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের বলী খেলোয়াড় মোরশেদকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। মোরশেদ ইফতার কিনতে বাজারে গেলে সেখানে তাকে হত্যাকারিরা ঘিরে ধরে পেটাতে ও কোপাতে থাকে। রোজাদার মোরশেদ ‘আমি রোজাদার, প্লিজ তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ইফতার পর্যন্ত প্রাণভিক্ষা দাও’-এমন আকুতি করেও সময়টুকু পায়নি। হত্যাকারিরা তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে চলে যায়। যশোরে চায়ের দোকানে বাগবিতণ্ডার জেরে অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুই ভাইকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ফরিদপুরে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে দুই যুবককে হত্যা করা হয়। এর আগে গত মাসে রাজধানীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে। একই সাথে এলোপাথাড়ি গুলিতে এক কলেজ ছাত্রী নিহত হয়। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ প্রভাব বিস্তার কারাকে কেন্দ্র করে এ খুনের ঘটনা ঘটে। দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।
দেখা যাচ্ছে, খুন, সন্ত্রাসের বেশিরভাগের সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের কোনো না কোনো সম্পৃক্ততা থাকে। আধিপত্য বিস্তার, আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতে তারা জড়িয়ে পড়ছে। এর জেরে প্রতিপক্ষকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিগত এক যুগের অধিক সময় ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের সর্বত্র দলের নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই আধিপত্যের মধ্যেই নিজেদের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে অনেকে খুনের শিকার হচ্ছে। ক্ষমতা ও প্রভাবপ্রতিপত্তির কারণে অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। এই একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষও ত্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মাঝে বেশ কিছুদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বরবরের মতোই বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের এ কথায় আস্থা রাখা যেত যদি একের পর এক সংঘটিত হত্যা, সন্ত্রাস, রাহাজানির রাস টেনে ধরা যেত। এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাতেই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস বেড়ে গেছে। এই প্রেক্ষিতে, সামনের দিনগুলোতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনমন ঘটার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বিভিন্ন খুন ও সন্ত্রাসের সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের সম্পৃক্ততা থাকায় অনেক সময় তারা পার পেয়ে যায়। এতে তারা আরও আস্কারা পেয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ পরিস্থিতির কথা সাধারণ মানুষেরও অজানা নয়। ফলে তারাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকে। সরকার বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিসংখ্যান ও ফিরিস্তি তুলে ধরছে। উন্নয়নের জয়গান গাইছে। অথচ তাদের জন্য উন্নয়ন, সেই জনগণ যদি নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে তা অর্থহীন হয়ে পড়া স্বাভাবিক। মানুষ আগে তার জীবনের নিরাপত্তা খোঁজে। ঘরে-বাইরে কোথাও যদি নিরাপত্তা না পায়, তাদের অসহায় হয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে কোনো উন্নয়নই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে না। মানুষের কাছে উন্নয়নের চেয়ে জীবনের নিরাপত্তা অগ্রগণ্য। সরকারকে উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘাতক-সন্ত্রাসী যে দলের বা যত বড় নেতা হোক না কেন, তাকে সন্ত্রাসী হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে মানুষ ঘরে-বাইরে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপদে থাকতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন