এক সময়ের খরস্রোতা কালীগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর বুকজুড়ে ধু-ধু বালুচর, কোথাও ফসলের আবাদ, কোথাও গো-চারন ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এক সময় নদীতে সারা বছর পানিতে ভরপুর থাকতো এখন বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়ই থাকে পানিশূণ্য। ৩ যুগ আগেও কালীগঙ্গায় চলত বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ। গ্রামাঞ্চলের মানুষ নদীর পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করতো। সেই পানিও কল-কারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে। এছাড়া কালিগঙ্গা নদীতে তরা, বেউথা, বালিরটেক, জামাশা ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি বড় ব্রিজ নির্মাণের ফলে নদীর কিছু অংশ সংকুচিত হয়ে গেছে। অবৈধ দখল এবং পলিতে ভরাট হয়ে গেছে নদী। নদী মরে যাওয়ার ফলে কৃষি নির্ভর এ এলাকার সেচ কাজও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, মানিকগঞ্জ জেলা ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতীসহ মোট ১১টি নদী। জেলার মোট আয়তন ১ হাজার ৩৭৯ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ২৪১ কিলোমিটার নদী এলাকা। কালীগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৭৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২৪২ মিটার। এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, দৌলতপুরের চর কাটারি এলাকায় যমুনা থেকে উৎপন্ন হয়ে কালীগঙ্গা ঘিওর উপজেলার আশাপুরের পাশ দিয়ে জাবরা, দুর্গাপুর ও তরা এলাকায় ধলেশ্বরীর সাথে মিশেছে। এখান থেকে গালিন্দা, নবগ্রাম, চরঘোসতা, আলীগর চর, শিমুলিয়ায় এসে পদ্মার সাথে মিশেছে। বর্তমানে এখান থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে হাতিপাড়া, বালুখন্দ, পাতিলঝাপ, শুল্লা হয়ে আলী নগরে এসে ধলেশ্বরীতে মিশেছে।
আশির দশকের শুরুর দিকেও কালীগঙ্গা দিয়ে বড় বড় ফেরি-লঞ্চ চলতে দেখা গেছে। আর আজ কালিগঙ্গার বুকে পানির অস্তিত্ব নেই বলইে চলে। বৃহৎ এ নদীটির দুরবস্থার কারণে শুধু নৌযান চলাচলই বন্ধ হয়নি, নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার জেলে পরিবারেও চলছে দুর্দিন। নদীতে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। অনেকেই মাছ ধরার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা পেশা বদল করতে পারেননি তাদের জীবন কাটছে মানবেতর ভাবে।
মানিকগঞ্জ সদর ও ঘিওর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, সদরের বেউথা, জামশা, লেমুবাড়ী, বালিরটেক, বান্দুটিয়া, পৌলী ও ঘিওর উপজেলার তরা, উত্তর তরা, কালিগঙ্গায় বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে আবাদ হচ্ছে ইরি বোরো ধানের আবাদ।
কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্তী পুটাইল গ্রামের সুরুজ্জামন বলেন, দুইযুগ আগেও নদীতে পানি ভরপুর থাকতো। জাহাজ ও লঞ্চ করে মানুষ ঢাকা রাজধানীর সাথে যাতায়াত করতো। বড় বড় পালতোলা নৌকা করে মালামাল এক জায়গা থেকে অন্য জাগায় নিয়ে যেতো। এখন আর সে দৃশ্য চোখে পড়ে না। প্রতিদিন এলাকার হাজার মানুষ, গরু ছাগল নদীতে গোসলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতো। বর্তমানে বর্ষার ২/৩ মাস পানি থাকে বাকি সময় শুকিয়ে যায়। তিনি বলেন, নদী খনন করে পানি প্রবাহের ধারা অব্যাহত রাখতে দ্রুত কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি, নইলে জীববৈচিত্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঘিওরের উত্তর তরা গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগেও কালিগঙ্গা নদীর এত খারাপ অবস্থা ছিল না। এই নদী এক সময় বাড়ির পাশে ছিল। মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। ঘরের কাজ, কৃষিকাজ সব নদীর পানি দিয়েই করতাম। এখন আর নদীতে পানি নেই। বেশির ভাগ জায়গা ভরাট হয়ে গেছে, দখল হয়ে গেছে।
মানিকগঞ্জর সদর উপজেলার কেওয়ারজানি গ্রামের মো. নজরুল ইসলাম জানান, আগে নদীর পানি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়া হতো। এখন পানির সঙ্কটে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিই একমাত্র ভরসা। মাছ, জলজ পতঙ্গ, পাখিসহ অনেক প্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী শুকিয়ে গেলে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে এ প্রাণী। কমবে মাছের প্রজনন। তাই কালীগঙ্গা নদী খননের দাবি জানান তিনি।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাইন উদ্দিন বলেন, পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ধলেশ^রী নদীর ৪৫ কিলোমিটার খননের কাজ করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ এর আওতায় নদীর খনন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও কালিগঙ্গা নদী ভাঙন রোধে ও স্বাভাবিক স্রোতধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি মেগা প্রকল্প আগামী একনেকে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন