সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিশ্বযুদ্ধের আশংকা : রাশিয়া দায় এড়াতে পারে না

প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সউদী আরব। দেশটির প্রতিরক্ষমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ আল আসিরি বলেছেন, সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে, যা পরিবর্তন করা যাবে না। তিনি আরও জানিয়েছেন, আইএসকে পরাজিত করতে আন্তর্জাতিক জোটের অধীনে লড়াই করবে সউদী আরব। ওদিকে ন্যাটো বলেছে, সে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস বিরোধী অভিযানে যোগ দেবে। সউদী আরব ও ন্যাটোর এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রাশিয়া বলেছে, সিরিয়ায় পশ্চিমা সেনা হস্তক্ষেপ বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পাশাপাশি বলেছেন, নতুন বিশ্বযুদ্ধ শুরু না করে সব শক্তির উচিত সিরিয়ায় সংঘাত অবসানে আলোচনার টেবিলে বসা। সিরিয়া হুমকির ভাষায় বলেছেন, সউদী আরব সৈন্য পাঠালে শুধু কাঠের কফিন ভর্তি লাশ পাবে। ইরান জানিয়েছে, সৈন্য পাঠালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে। বলা নিষ্প্রয়োজন, সিরিয়া-সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিশ্বযুদ্ধের আশংকা কিংবা বাস্তবতা কারো কাম্য হতে পারে না। রুশ প্রধানমন্ত্রী সৈন্য না পাঠিয়ে সংঘাত নিরসনে আলোচনায় বসার তাগিদ দিলেও এই বিশ্বযুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রাশিয়ার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। চার মাস আগে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এই সংঘাতে সরাসরি অনুপ্রবেশ করে রাশিয়া এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, সিরিয়া-সংঘাতে সরাসরি অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাশিয়াই বিশ্বযুদ্ধের আশংকা সৃষ্টি করেছে। রুশ বিমান হামলা ও আসাদ বাহিনীর চ-নীতির কারণে বেসামরিক প্রাণহানিই শুধু বেড়ে যায়নি, ঐতিহাসিক স্থাপনা, মসজিদ ইত্যাদিও ধ্বংসের শিকারে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায়, পাল্টা ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়ার কথাই বিবেচনা করেছে। সউদী আরব, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ও ন্যাটো ।
যুদ্ধ ও সংঘাত নিরসনে জেনেভায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনা নিষ্ফল প্রতিভাত হয়েছে। পরবর্তীতে কয়েকটি দেশের মিউনিখ আলোচনাও কোনো তাৎক্ষণিক ফল দেয়নি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এই আলোচনায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সাহায্য দেয়া এবং শান্তি আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এটি বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে বিবেচ্য হলেও রাশিয়া তার বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং বাসার আল আসাদ জানিয়ে দিয়েছেন, বিদ্রোহীদের কবলমুক্ত করে সমগ্র দেশকে তার নিয়ন্ত্রণে নিতে তিনি বদ্ধপরিকর। যুদ্ধ বিরতি ও শান্তির আলোচনা যখন ভেঙে যায়নি, বরং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে, তখন রাশিয়ার ভূমিকা উস্কানিমূলক এবং বাশার আল আসাদের বক্তব্য আপসবিমুখতার উদাহরণ। যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রয়াস বিলম্বিত করার মাধ্যমে বাসার আল আসাদের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি সঙ্গতকারণেই সউদী আরব, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ও ন্যাটোর পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। এই প্রেক্ষিতে সউদী আরবের সিদ্ধান্ত, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থনের তাৎপর্যটি বিশেষভাবে অনুধাবন করা যায়। এ প্রসঙ্গে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র রফতানির মাধ্যমে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সেখানে সামরিক আগ্রাসন ও নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠা করেছিল দেশটি। তার জের ধরে যে দীর্ঘযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল যার অবসান ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের মধ্য দিয়ে। স্মরণ করা যেতে পারে, ওই যুদ্ধে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুজাহিদদের সমর্থন ও সাহায্য দিয়েছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। পরবর্তীকালের ইতিহাস সবারই জানা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্রের দখলে এখন আফগানিস্তান। যুদ্ধ চলছেই সেখানে। মারা যাচ্ছে মানুষ ও ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতিসহ সবকিছু। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিভূ-প্রতিনিধি হিসেবে রাশিয়া এখন সিরিয়াতে একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মিত্র বাশার আল আসাদকে রক্ষার জন্য সেসব কিছুই করছে। এর পরিণতি কি হতে পারে, ভাবছে না।
স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে বাশার আল আসাদের পরিচিতি কারো অজানা নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিশেষ করে সুন্নী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছেন তিনি, তার কোনো তুলনা নেই। তার বাহিনীর হাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত ও সর্বহারা হয়েছে। তার অব্যাহত হত্যা এবং দমন-পীড়ন-উৎসাদনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ‘বিদ্রোহী বাহিনীর’ উদ্ভব হয়েছে। গত প্রায় ৫ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। এর মধ্যেই প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, ১৯ লাখ আহত হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ও ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। উদ্বা¯ুÍ ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের মানবিক দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের কোনো শেষ নেই। খবরে জানা গেছে, ৩০ হাজার সিরীয় শিশু ইউরোপ থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। দেশটির অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষতিও বেশুমার। এই দেশটিই এখন বিশ্বযুদ্ধের সূচনাস্থল হতে যাচ্ছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, যুদ্ধই যদি সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতো না এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ব যুদ্ধ ও সংঘাতময় হয়ে উঠতো না। সিরিয়া কার্যত পরস্পরবিরোধী শক্তিচক্রের শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আশংকিত বিশ্বযুদ্ধ যদি বেধেই যায়, তাহলে করুণ পরিণতি শুধু সিরিয়া বা ওই অঞ্চলের দেশগুলোর হবে না, গোটা বিশ্বের হবে। কাজেই এখনই সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। যুদ্ধ-সংঘাত নিরসন ও শান্তি স্থাপনে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ধৈর্য, সহনশীলতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। রাশিয়াকে অবিলম্বে তার বিমান হামলা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বাশার আল আসাদকে সমঝোতার পথে আসতে উৎসাহিত বা বাধ্য করতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধের হুমকি বা আশংকা ব্যক্ত না করে এই কাজটি করবে এবং সউদী আরব, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ও ন্যাটোও সংযম-সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে। যে কোনো অবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Habibur Rahman ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৯:১৫ এএম says : 1
এখানে কেন শুধু রাশিয়ার সমালোচনা করা হল?সরকার পরিবর্তনের চেষ্টার ফলাফল লিবিয়া,মিশর কেন উদাহরণ হল না?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন