শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিশুদের অধিকার

সাঈদা সুলতানা | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

শিশুরাই হলো পৃথিবীতে মানবজাতি রক্ষার বহমান স্রোত। নতুন শিশুর জন্ম না হলে পৃথিবী থেকে মানবজাতি হারিয়ে যাবে। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবার ও বংশ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম নতুন শিশুর জন্ম। শিশু মা-বাবার ভালোবাসার ধন। আজকের শিশুই আগামী দিনের পরিপূর্ণ মানুষ। মা-বাবা ছাড়া পৃথিবীতে শিশু জন্ম নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। মা-বাবার ভালোবাসা ও রক্ষণাবেক্ষণে বেড়ে ওঠে শিশু, হয়ে ওঠে সমাজ, দেশরক্ষার হাতিয়ার। সামাজিকভাবে শিশুর নামে কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, যেমন অনাথ শিশু, অবৈধশিশু, ছিন্নমূল-পথশিশু ইত্যাদি। জন্মের পর মা-বাবা হারানো সন্তানকে অনাথ বা এতিমশিশু, বিবাহ বহির্ভূত নর-নারীর সন্তান অবৈধ, ঠিকানা বিহীন রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুরা ছিন্নমূল বা পথশিশু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।

মা-বাবা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালোবাসা, বাসযোগ্য স্থান, খাদ্য এবং শিক্ষা লাভের সুযোগ শিশুর মৌলিক অধিকার। অধিকাংশ দেশেই অভিভাবকের দিকনির্দেশনায় কিংবা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক শিক্ষানীতির আলোকে শিশুরা বিদ্যালয়ে গমন করে। ক্ষুদে শিশুরা খেলার ছলে শৈশবকালীন শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলে। কিন্তু অনুন্নতদেশে প্রায়শঃই শিশুদের জীবনযুদ্ধে অর্থ উপার্জনে শ্রমকার্যে অংশ নিতে হয়। শিশুরা শারীরিক-মানসিকভাবে যত উন্নত হবে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ তত সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি ততটা উন্নত নয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বহু শিশু বেঁচে থাকা, শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেকক্ষেত্রে অভাবের তাড়নায় অভিভাবকরা তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা নিজেরাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে তারা। শিশুদের এ অবস্থা থেকে রক্ষার আইন, সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সনদ ও প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে পরিপূর্ণ সুফল মিলছে না।

মা-বাবার ভালবাসা শিশুর জন্মগত অধিকার। বিভিন্ন কারণে মা-বাবার মাঝে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, এতে শিশুর জন্য এ ভালবাসা হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। বিচ্ছেদের পর বেড়ে উঠতে হয় মা কিংবা বাবার একক ভালবাসায়। অনেকক্ষেত্রে উভয়ের ভালবাসা থেকেই বঞ্চিত হতে হয় শিশুকে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য বা তৃতীয় পক্ষের দায়িত্বে বেড়েউঠে শিশু, শিকার হয় লাঞ্ছনার, স্বজনহীন নির্দয় এক পরিবেশই হয়ে উঠে শিশুটির একমাত্র ঠিকানা। শিশু অধিকার, শিশু সনদ সেখানে অর্থহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। ২০২০ সালে দুই সিটিতে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে (সূত্র-২৬ জুন, ২০২১ কালের কণ্ঠ)। ব্যাপক হারে বিচ্ছেদের ঘটনায় অসহায় শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ কমিয়ে আনা, যাতে শিশুরা তাদের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একক পরিবার বাড়ছে। যৌথ পরিবারে কিছু সুবিধা থাকে, একক পরিবারে তা হয়ে উঠে না। যৌথ পরিবারে শিশুর সমস্যায় সবাই এগিয়ে আসে, শিশুরা একাকীত্বে ভোগে না, লালন পালন সমস্যা হয় না, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, খেলাধুলার পরিবেশ থাকে, মিলেমিশে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়। একক পরিবারগুলোতে স্বামী কিংবা স্ত্রী, অনেক ক্ষেত্রে উভয়কেই কাজ করতে হয়। শিশুরা একাকীত্বে ভোগে, বেড়ে ওঠে কাজের মানুষ বা নিকট আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে। সঠিক যত্ন নেওয়া সম্ভব হয় না, সৃষ্টি হয় তাদের নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। অনেকক্ষেত্রে শিশুদের যৌন হয়রানিরও শিকার হতে হয়। কিছু কিছু পরিবার ডে-কেয়ার সেন্টারের সহায়তা নিয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতায় এর সহায়তা নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

পাড়া-মহল্লায় খেলারমাঠগুলো ক্রমেই কমে আসছে। বিনোদন কেন্দ্র যা আছে, তাও অপ্রতুল। অথচ, খেলাধুলার পরিবেশ ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খেলাধুলার পরিবেশ ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরির ব্যবস্থা করা জরুরি।

ষোড়শ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৫ বছর। এর প্রধান কারণ ছিল জন্মগ্রহণকারী দুই-তৃতীয়াংশ শিশু ৪ বছর বয়সের পূর্বে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের সময়কালে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে শিশুদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনসংখ্যার সাথে জড়িত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ জানান, শিশুমৃত্যুর হার ১৯৯০-এর দশক থেকে বেশ কমতে শুরু করে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ৫ বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যু ৪২% কমে যায়। অন্যদিকে সার্বিয়া এবং মালয়েশিয়ায় এ হার ছিল প্রায় ৭০%। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত শিশুরা বিশ্ব ব্যাংকের জরিপে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে, যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে নগরায়ন। দুর্যোগের পাশাপাশি কাজের সন্ধানে শহরে আসে গ্রামের মানুষ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, ৩০ বছর পর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস করবে শহরে। বাংলাদেশ দ্রুততার সাথে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু নবজাতক শিশুদের মৃত্যুর উচ্চসংখ্যাশীর্ষক তালিকায় শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। হ্রাস পেয়েছে খর্বকায়ত্ব কমিয়ে আনার হার। সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত এখনও সম্ভব হয়নি। স্যানিটেশন ব্যাবস্থার অনেক উন্নতি সত্ত্বেও, সুরক্ষিত টয়লেট ও হাত ধোয়ার সুবিধা পাচ্ছে না অনেকেই। এর সাথে আছে পুষ্টি, শিক্ষা, খেলাধুলা এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা। প্রশিক্ষণের অভাবে শিশুদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্কুলে কিশোরী ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য টয়লেট সুবিধা নেই। মেয়ে শিশুরা নিরাপত্তা এবং যৌন হয়রানির কারণে অনেক সময় পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে অনেক ঘাটতি। শিশুশ্রমের সাথে জড়িত আছে ১৭ লাখ শিশু। যদিও সরকার এসব ক্ষেত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার আগের তুলনায় কমেছে। আরো অধিক সফলতার লক্ষ্যে বয়সন্ধিকাল পেরোচ্ছে এমন শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও তাদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণস্বাস্থ্যব্যবস্থা। শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিশু বা শিশু অপরাধীদের নিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সংবেদনশীলতার প্রয়োজন। শিশুদের সামাজিক সুরক্ষায় প্রয়োজন জরুরি বিনিয়োগ। এর আওতায় আনতে হবে প্রতিবন্ধী শিশুদের, যদিও সরকার এ বিষয়ে যত্নবান এবং লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘সার্ভিসেস ফর দ্যা চিলড্রেন এট রিস্ক’ নামে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী, শিশু ও যুবসম্প্রদায় কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা নীতিসমূহের দাবি এবং উপযুক্ত সেবাপ্রাপ্তির মাধ্যমে নির্যাতন, অবহেলা, শোষণ ও পাচার বিলোপ সাধনে সক্ষম করা এবং প্রকল্পের স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রমে দরিদ্র এবং নির্যাতিত পরিবারের নারী, শিশু ও যুবসম্প্রদায়ের অভিগম্যতার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে নির্যাতন, সহিংসতা এবং শোষণের প্রকোপ কমিয়ে আনা। শিশু অধিকার সনদ ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইনী কাঠামো এবং বিশেষ শিশুনীতি গ্রহণ ও দেশের সকল শিশু, বিশেষ করে দুস্থ শিশুদের কল্যাণ সাধন করা। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন এবং শোষণ প্রতিরোধকল্পে ইতিবাচক ও সহায়ক সামাজিক আদর্শের অনুশীলন, উন্নয়ন ও সুদৃঢ় করাও প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান কাম্য।

২০১৩ সালে কার্যকর হওয়া শিশু আইন, দেশের সব জেলায় শিশু আদালত গঠনের বিধান রেখে সংসদে শিশু আইন সংশোধন বিল ২০১৮ পাস হয়েছে। দায়রা আদালতে যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারে, আইন সংশোধনের ফলে শিশু আদালতও সে ক্ষমতার অধিকারী হলো। শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের জাতি গঠনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য।

শিশুকে আমরা যে নামেই চিহ্নিত করি না কেন, একটি মানবশিশু জন্মের মাধ্যমেই পৃথিবীতে তার কিছু অধিকার সৃষ্টি হয়, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব একসময়ের শিশু থেকে বেড়ে ওঠা পরিপূর্ণ মানুষ ও মানুষ দ্বারা পরিচালিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছাড়পত্রে যথার্থই লিখেছেন-‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপপিঠে, চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন শিশু যদি পরিপূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারে, তবেই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সকল ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণতা পাবে এবং কবি সুকান্তের রেখে যাওয়া অঙ্গীকারও আমরা বাস্তবায়ন করে সকল শিশুর অধিকার নিশ্চিত তাদেরই জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব নিশ্চয়ই।

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন