রাজধানীর ফুটপাথ, দোকানপাট ও মার্কেটে চাঁদাবাজি এখন জোরদার। ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন চাঁদাবাজচক্র ফুটপাথ, অস্থায়ী-স্থায়ী কাঁচাবাজার, ছোট-বড় দোকান, বিপনি বিতান এমনকি ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে। এসব চাঁদা সরকারি দলের নেতাকর্মী, দুর্নীতিবাজ পুলিশ, গডফাদার, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের পকেটে যাচ্ছে। চাঁদা আদায়কারীদের বলা হয় লাইনম্যান। এরা চাঁদাবাজদের পক্ষে চাঁদা আদায় করে। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের কাজে নিয়োজিত আছে এমন গ্রুপের সংখ্যা দুই শতাধিক, সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয় শত। এবার ফুটপাথ, বাজার ও দোকানপাট থেকে অন্তত দৈনিক ১০ কোটি টাকার চাঁদা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, চাঁদাবাজরা ইতোমধ্যেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা শারীরীক উপস্থিতি ছাড়াও চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার ইত্যাদিও ব্যবহার করছে। ব্যবসায়ীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রকাশ্য গুলি করে হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা ভীত-সন্ত্রস্ত বোধ করছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশ সরকারি দলের বিভিন্ন সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠনের এক শ্রেণির নেতাকর্মী। তারা নানা অসিলা ও উপলক্ষে চাঁদা আদায় করছে। ব্যবসায়ীদের মতে, চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার উপায় নেই। কখনো কখনো চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলে। অভিযানে গ্রেফতারও হয় অনেক চাঁদাবাজ। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। এসে যথারীতি চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়।
চাঁদাবাজি আমাদের দেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আসলে এটা বিনাপুঁজির অতি লাভজনক এক ব্যবসা। সঙ্গতকারণেই ক্ষমতাসীন দল, তার সহযোগী কিংবা অঙ্গ সংগঠনের এক শ্রেণির নেতাকর্মী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এ জন্য প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতেও তারা পিছপা হয় না। বলা হয়, যেখানে চাঁদাবাজি সেখানেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। এর বাইরে পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য ও কর্মকর্তা চাঁদাবাজির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে থাকে। স্থানীয় প্রভাবশালী কিংবা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। শীর্ষসন্ত্রাসী ও গডফাদারদের নামেও চাঁদাবাজি চলে। ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীই যেহেতু চাঁদাবাজদের টার্গেট, সুতরাং চাঁদার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে পণ্যমূল্যের ওপর। চাঁদা দেয় ব্যবসায়ীরা। এজন্য তাদের অবশ্য কোনো আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয় না। তারা দেয় চাঁদার সঙ্গে পণ্যের মূল্য সমন্বয় করে একটা দাম নির্ধারণ করে এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে তা আদায় করে। কার্যত পণ্যের আসল ও বাড়তি মূল্য ক্রেতাসাধারণকেই দিতে হয়। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির একটা বড় কারণ যে চাঁদাবাজি, এখন সবাই একবাক্যে তা স্বীকার করেন। দেখা যায়, অনেক সময় উৎপাদক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। আবার ভোক্তা পর্যায়ে বিশেষ করে রাজধানীর বাজারে সেই পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য গুনতে হয় ক্রেতাদের। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায়, রাজশাহীর বানেশ্বর বাজার থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে ট্রাকভাড়া ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু রাজশাহীর আমচত্বর, বেলপুকুরিয়া, নাটোর বাইপাস, এলেঙ্গা বাইপাস, টাঙ্গাইল বাইপাস, কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয় দেড় থেকে দু’হাজার টাকা। এই বাড়তি টাকা কাদের পকেট থেকে যায়, তা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। আবার উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য পৌঁছাতে কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। এগুলো হচ্ছে, স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্থানীয় মজুতদার, স্থানীয় খুচরাবাজার, ব্যবসায়ী, পাইকারী ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় বাজার, আড়তদার, প্রক্রিয়াজাতকারী ইত্যাদি। এই প্রতিটি ধাপেই পণ্য মূল্য বাড়ে এবং এর সবই শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়ে গিয়ে চাপে। আলু, টমাটো, বেগুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি বেচে যেখানে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না, সেখানে রাজধানীর ক্রেতাকে ওইসব পণ্য প্রতিকেজি যথাক্রমে ২৫ টাকা, ৩৫ টাকা, ৫০ টাকা টাকা, ৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। এরপরও বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছেই। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যশ্রেণির মানুষও এখন পণ্যমূল্যে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। তারা লজ্জা-শরম ভেঙ্গে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন দিয়েও পার পাচ্ছে না। খবর বেরিয়েছে, অনেকই খাদ্যের পরিমাণ কমিয়েছে, দু’ বেলার জায়গায় একবেলা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। কম খাদ্য গ্রহণের কারণে তাদের পুষ্টিহীন, দুর্বল ও রোগব্যাধীর শিকার হওয়ার আশংকা রয়েছে বলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের অভিমত। পণ্য থাকলে কোনো লাভ নেই, সেই পণ্য কেনার ক্ষমতা মানুষের থাকতে হবে। এটাই আসল। অতীতে এ দেশে যেসব দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তার অন্যতম কারণ ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া বা না থাকা। শ্রীলংকার এখনকার অবস্থা মর্মান্তিক। তেমন অবস্থা আমাদের দেশে দেখা দিতে পারে কিনা, প্রশ্ন উঠেছে। এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। যেকোনো কিছু যেকোনো সময় ঘটতে পারে। পণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এনে স্থিতিশীল করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ। আর এ জন্য সকল প্রকার চাঁদাবাজি রহিত করা আবশ্যক। তাতে পণ্যমূল্য অনেকটাই কমে আসবে। এইসঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর কারসাজি ডেড স্টপ করতে হবে। পুলিশের অভিযানে কিংবা ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে আশ্বস্থ হওয়ার কোনো কারণ আমরা দেখি না। কারণ, পুলিশের কিছু লোক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। আর ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সিন্ডিকেটবাজ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা জানেন। মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ওপর বিশ্বাস রাখছে। আশা করছে, তিনিই চাঁদাবাজি নিরোধ করতে পারেন। কীভাবে, সেটাও তারই ভালো জানা আছে। প্রধানমন্ত্রী এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবেন, আমরাও সেটা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন