রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন সারাদেশেই ডায়রিয়া রোগের পাদুর্ভাব ঘটেছে। ৩ মাসে ৪ লাখ ৬১ হাজার মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ পানিবাহিত কলেরা রোগী। পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। একইসাথে তারা পানির উৎস ও মান খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষ করে ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া। শুধু মার্চ মাসেই দেশজুড়ে আক্রান্ত ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বছরের প্রথম ৩ মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন। এরমধ্যে ঢাকায় রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজার। আর ১ লাখ ২ হাজার রোগী নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে খুলনা বিভাগ।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন চৈত্র মাস। প্রচণ্ড গরম চলছে। গরমে ডায়রিয়ার জীবাণু বেশিক্ষণ বেঁচে থাকে। তাছাড়া অনেকেই অনিরাপদ পানি পান করেন। এতে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই বাইরের খাবারের পাশাপাশি যেখান-সেখান থেকে পানি খাওয়া যাবে না।
মার্চে রংপুর ছাড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে সব বিভাগে। এসময় ঢাকা বিভাগে রোগী ৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ হাজারে। এপ্রিলে প্রকোপ আরও বেড়েছে। মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ১৪শ’ রোগী। পরিস্থিতি সামাল দিতে সব হাসপাতালের চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ চিকিৎসদের।
জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবি’র সিনিয়র সায়েনটিস্ট ডা. যোবায়ের মোহাম্মদ চিশতী বলেন, প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে ১৩শ থেকে ১৪” রোগী। ১৪শ’ রোগী কিভাবে ম্যানেজ করা সম্ভব। এখানে সরকারের সাহায্য অবশ্যই দরকার। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ডায়ারিয়া রিলেটেড যে বেডগুলো আছে সেগুলো কাজে লাগান দরকার।
এদিকে, কলেরা হাসপাতালে যেসব রোগী আসছেন, তাদের প্রায় সবাই পাইপলাইনের দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত পানিকে দায়ী করছেন। রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, ঢাকার ওয়াসার লাইনে সারাদিনই খারাপ পানি আসে। বাধ্য হয়েই পানি পান করতে হবে। তবে সকাল ৮টা থেকে ১০ পর্যন্ত কিছুটা ভাল পাওয়া যায়।
আইসিডিডিআরবি’র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কলেরায় আক্রান্ত বলে জানা গেছে। হাসপাতালে আসার পথে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ জন রোগী মারা গেছে বলে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলেরা জীবানু সবসময়ই ছিল। তবে অনিরাপদ পানি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেই কলেরার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, পানি যখন কমে যায় তখন এটার ঘনত্ব বেড়ে যায়। তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে এটা খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে। এছাড়া পচা-বাসি খাবারের মধ্যে এটার দ্রুত বিস্তার ঘটে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, কোন জায়গা থেকে রোগী আসছে, ওই জায়গাতে গিয়ে পানি ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞদের দেখা উচিত। রাস্তার মধ্যে ওয়াসার পাইপে কোথাও লিকেজ হতে পারে। সেগুলো সারিয়ে তোলা জরুরী। দূষিত পানি পানে শুধুমাত্র কলেরা নয়, টাইফয়েড জন্ডিসসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। তাই নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার পাশাপাশি পানি ও পয়নিঃষ্কাশন লাইনে ত্রুটি খতিয়ে দেখার পরামর্শ বিশেজ্ঞদের।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ থামছে না। গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৪ জন। গরমের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ঘরে ঘরে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে বাসাবাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। তবে যাদের অবস্থা গুরুতর কেবল তারাই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২৯ জন।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, করোনা চোখ রাঙ্গানি কিছুটা প্রশমিত হবার সাথে ডায়রিয়া পরিস্থিতি দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা না বড়লেও গত এক সপ্তাহে নতুন করে আরো প্রায় ৩ হাজার নারী-পুরষ ও শিশু ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে এ অঞ্চলের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তে সংখ্যা ৪’শ কোটায়। গত একমাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার।
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানায়, নারায়ণগঞ্জের ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের (ভিক্টোরিয়া) ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর বিছানা আছে ২০টি। ২০টি বিছানার বিপরীতে গত শনিবার সকাল আটটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত বহির্বিভাগে ডায়রিয়ার সমস্যায় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছে প্রায় ৩ শতাধিক রোগী। হাসপাতালে বর্তমানে ধারণক্ষমতার চেয়ে সাড়ে ছয় গুণ রোগী ভর্তি হয়েছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, মাদারীপুর থেকে জানায়, গত এক সপ্তাহে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। যার শতকরা ৮০ ভাগেই শিশু। এক সপ্তাহে জেলা সদর হাসপাতালেই ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন আড়াইশ রোগী। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাবার খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোঁয়াসহ তরলজাত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সিভিল সার্জন।
রাজবাড়ী জেলা সংবাদদাতা জানান, রাজবাড়ীতে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২জন রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকাল সকাল ১১ টার দিকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেঝোতে গাদাগাদি করে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীরা রয়েছে। সিট না পেয়ে এক রোগীকে গাছতলায় চিকিৎসা প্রদান করতে দেখা যায়। রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল সূত্রে জানায়, হঠাৎ করেই গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া প্রকোপ দেখা দেওয়ায় চিকিৎসা নিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
বরগুনা জেলা সংবাদদাতা জানান, বরগুনায় ব্যাপক হারে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে হাসাপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশী রোগী ভর্তি হয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় হাসপাতালের মেঝেতেই থাকছেন ডায়রিয়ায় আক্রান্তরা। রোগীদের চাপ থাকায় গত ২-৩ দিন ধরে মেঝেতেও যায়গা পাচ্ছেনা রোগীরা। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
পিরোজপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, প্রচন্ড গরমে সারা দেশের ন্যায় পিরোজপুরেও বেড়েছে ডায়রিয়ার সংক্রমণ। ধারণ ক্ষমতার থেকে দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি হাওয়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৩ জন। এদিকে জেলা হাসপাতালের ২৪ বেডের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৫৩ জন। মেঝেতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন রোগী। অপরিচ্ছন্নতা আর হাসপাতালের সার্ভিস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
রামগতি (লক্ষ্মীপুর) উপজেলা সংবাদাতা জানান, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের খাবার বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঠিকমতো খাবার না দেওয়া ও নিম্নমানের খাবার বিতরণের অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী রোগীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাদ্য তালিকায় চিকন চাল (ফাইজাম) থাকলেও রোগীদের দেয়া হচ্ছে মোটা চালের ভাত। মাছ খাওয়ানোর তালিকায় রয়েছে পাঙ্গাস মাছ। সময় মত দেয়া হচ্ছে না রোগীদের নিয়মিত খাবার। এমন আরো বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে।স ংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল নজরদারীর অভাবে এসব নিম্নমানের খাবার বিতরণ করা হয়। আবার খাবার না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন