আমরা এখন কোন সমাজে এবং কোন দেশে বসবাস করছি, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একের পর এক ভয়াবহ, নৃশংস ও বর্বর ঘটনা যেভাবে আমাদের গ্রাস করছে, তাতে এ প্রশ্ন তোলা অসংগত নয়। অপরাধের ধরন এতটাই অমানবিক এবং নৃশংস হয়ে উঠেছে যে, এসব ঘটনায় বিবেকবান মানুষ মাত্রই শিউরে উঠছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশেই হঠাৎ বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। ব্যক্তিগত বিরোধ, পারিবারিক কলহ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক বাণিজ্য ও চুরি-ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বেড়েছে।
সম্প্রতি ঢাকার শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে মাইক্রোবাসে করে বাসায় ফেরার পথে গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। এ ঘটনায় গুলিতে প্রীতি নামে রিকশাযাত্রী এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। দন্ত্য চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন। দুই সন্তান নিয়ে সবুজবাগের একটি চারতলা বাড়ির দোতলায় থাকতেন গৃহবধূ তানিয়া আক্তার। এসি মেরামতের কথা বলে কয়েক দুর্বৃত্ত তার ঘরে ঢুকে ডাকাতির চেষ্টা করে। এতে বাধা দিলে স্কচটেপে তার দুই সন্তানের মুখ বেঁধে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে রাজধানীতে ৩ হাজার ৩৭৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বছরে গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ সময়ে। আবার পুলিশ সদর দফতরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ হাজার ৩০৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে প্রতিবছর ৩ হাজার ৮২৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৭৬টি। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমলেও ২০২১ সালে তা আবার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী চার বছরের গড় সংখ্যার তিনগুণেরও বেশি।
এদিকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতরের ওয়েবসাইটে অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হতো। ২০১৯ সালে আংশিক তথ্য দেওয়া হলেও এর পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এতে কী পরিমাণ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং কতগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়েছে সে তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এতে অপরাধের প্রকৃত চিত্রও জানা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ, অপরাধের সঠিক তথ্য জানা নাগরিকদের অধিকার। এর ফলে অপরাধের প্রকৃত চিত্র জানাসহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করা সম্ভব হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে নাগরিকদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের নাগরিক বিবেচনায় না হয়ে এখন অবস্থানের ভিত্তিতে হয়ে গেছে। একইভাবে রাজনীতি ‘আদর্শের’ বদলে ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক’ হওয়ায় দেশে অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধ এখন বেড়েছে।
ডিএমপির এক তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের গত দুই মাস ২৭ দিনে রাজধানীতে ৩৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন ও মার্চ মাসের প্রথম ২৭ দিনে ১৩ জন খুন হয়। এর মধ্যে কতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সেটির হিসাব নেই। তবে আসকের তথ্যে দেখা গেছে, এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। শুধু জানুয়ারিতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৯টি। ২০২১ সালে প্রতিমাসে এই হত্যাকাণ্ডের গড় সংখ্যা ছিল ১৩। এ হিসাবে গত জানুয়ারিতে তিনগুণ বেড়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সারা দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৫৭টি, ২০২০ সালে ৩১টি, ২০১৯ সালে ৩৯টি, ২০১৮ সালে ৬৭টি, ২০১৭ সালে ৫২টি, ২০১৬ সালে ১৭৭টি ও ২০১৫ সালে ১৫৩টি। এতে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালে ১৭৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ২০১৭ সালে কমে ৫২টিতে দাঁড়ায়। পরে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালেও এ সংখ্যা কম ছিল। এই তিন বছর গড়ে ৪৫টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে হঠাৎ ২০২১ সালে আবারও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ওই বছর ১৫৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পূর্ববর্তী তিন বছরের গড় সংখ্যার তিনগুণেরও বেশি।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, স্বয়ং পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ খুন, ধর্ষণ, মাদক সেবন ও চোরাচালানের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত বসবাস করছে। অপরদিকে দিনকে দিন দেশের রাজনীতি চলে যাচ্ছে নীতিহীনতার অতল গহ্বরে। ক্ষমতাসীন রাজনীতির ওপর ভর করে বেড়ে উঠছে বিশাল এক দুর্বৃত্ত শ্রেণি। রাজনীতি তাদের কাছে এখন অপরাধ-দুর্নীতির শক্তিশালী হাতিয়ার। প্রাইভেট বাহিনী গড়ে লুটতরাজ, টেন্ডারবাজি করছে তারা। রাজনীতিক নামের কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীও নানা স্বার্থে লালন-পালন করছে এই দুর্বৃত্ত শ্রেণিকে। দেশের নষ্ট রাজনীতির ঢেরায় বেড়ে ওঠা এই অপরাধের প্রোডাক্টগুলো শেয়ারবাজার, বিদেশে টাকা পাচার, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লুট, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি, বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ক্যাসিনোর সঙ্গে মহামারিবাণিজ্য বাংলাদেশকে কলঙ্কতিলক এঁটে দিয়েছে।
বর্তমানে দেশের সুশাসন, নারী অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার থাকা চেতনার কাণ্ডারীরা এসব নিয়ে এখন মোটামুটি চুপই বলা যায়। তারা এসব নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে নাকি দলকানা সুবিদাবাদীর মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন সেটা বুঝা যাচ্ছে না।
সার্বিক বিবেচনায়, রাজনীতিতে নীতি-মূল্যবোধের অবক্ষয় সুস্থ চিন্তা-চেতনায় আর কতো ধস নামাবে?Ñ এ প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছে বিবেকবানদের। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় তারাও খামোশ। একদিকে তাদের নীরবতা, আরেকদিকে দুর্বৃত্তদের উত্থানের ফাঁকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে বহুল প্রচারিত হচ্ছে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি যেমন, রাস্তা, ব্রিজ, ভবনসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সূচক, গড় আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির যত তথ্যে। সাধারণ মানুষের জীবনমান, নিরাপত্তা, নীতি-নৈতিকতা সেখানে যেন কোনো বিষয়ই নয়।
লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাস, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অধঃপতন ও শূন্যতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার অভাব দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসে আছে। এসব শিকড় জন্ম দিচ্ছে নিত্যনতুন নৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপরাধ। এসব অপরাধ ধ্বংস করছে সততা, নীতিনৈতিকতা ও মানবতাবোধ। শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। ছিঁড়ে ফেলছে সামাজিক বুনন। আর অপমৃত্যু ঘটিয়েছে রাজনৈতিক সৌন্দর্য্যের । রাজনীতির অর্থই পাল্টে গেছে।
নৈতিকতাবোধ কেন হারিয়ে যাচ্ছে? দেশপ্রেমের কেন এ দশা? কেন গড়ে উঠছে না ন্যায্য সমাজ ব্যবস্থা?Ñ এসব প্রশ্ন নিয়ে সামনে আগুয়ান হওয়ার সামাজিক শক্তিও ফেরারি হয়ে পড়ছে। এসবের কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা, সমস্যাগুলোর শিকড় চিহ্নিত করা, সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি।
সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে তা বর্তমান সরকারকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক, পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক সবক্ষেত্রেই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করতে হবে। উট পাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে ঝড় উপেক্ষা করার প্রবণতা থেকে সরকারকে বের হয়ে এসে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও অপরাধ প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের উপর দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানুষ যাতে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে না পারে, এজন্য পুলিশের নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং দলীয়, রাজনৈতিক মানসিকতার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। সমাজের অভিভাবক শ্রেণিকেও সচেতন হতে হবে। মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টিতে তাদের কাজ করতে হবে। জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানুষের অধিকারের বিষয় সম্পর্কে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
rintu108@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন