রাজধানী কিয়েভের আশেপাশের এলাকা থেকে রাশিয়া তার সৈন্যদের প্রত্যাহারের পর তাদেরকে ইউক্রেনের পূর্ব দিকে নিয়ে গেছে। তাদের মনোযোগের কেন্দ্র এখন এই পূর্বাঞ্চল যা ডনবাস নামে পরিচিত। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে এই যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের এই প্রাচীন শিল্পাঞ্চলকে "মুক্ত" করতে হবে। কিন্তু তার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাকে কী করতে হবে এবং সেটা কি সম্ভব হবে? রুশ সৈন্যরা মারিউপোল শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ইতোমধ্যে মানবিক বিপর্যয়ের সূচনা করেছে। তবে তারা এখনও সেখানে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পরাজয় ঘটাতে পারেনি।
ইউক্রেনের সবচেয়ে সু-প্রশিক্ষিত বাহিনীগুলোকে ইতোমধ্যেই পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। কারণ গত আট বছর ধরে সেখানে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তাদের লড়াই চলছে।
এসব যুদ্ধে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারপরেও তারা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। ওই অঞ্চলে রাশিয়ার নতুন করে শক্তি জড়ো করার জবাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন: "আমাদের প্রত্যেক মিটার জমির জন্য আমরা লড়াই করবো।"
প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ডনবাসের কথা বলেন তখন তিনি ইউক্রেনের কয়লা এবং ইস্পাত-উৎপাদনকারী অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ দুটো অঞ্চল লুহান্সক এবং দনিয়েৎস্ক-এর সমগ্র এলাকাকে বোঝান। এই এলাকা দক্ষিণের মারিউপোল বন্দর-শহর থেকে শুরু করে উত্তরে রুশ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোট নেটো মনে করে রাশিয়া এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে দনিয়েৎস্ক থেকে ক্রাইমিয়া পর্যন্ত দক্ষিণ উপকূলে একটি স্থল করিডোর প্রতিষ্ঠার করতে চায়।
"মূল বিষয় হচ্ছে ক্রেমিলন এই অঞ্চলকে ইউক্রেনে রুশ-ভাষীদের অংশ বলে চিহ্নিত করেছে যার অর্থ এই অঞ্চল ইউক্রেনের চেয়েও অনেক বেশি রাশিয়া," বলেন ব্রিটেনে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট বা রুসির স্যাম ক্র্যানি-ইভান্স। এসব অঞ্চলে হয়তো রুশ-ভাষী লোকেরাই বসবাস করেন, কিন্তু তারা এখন আর রুশ-পন্থী নন।
"মারিউপোল একসময় ছিল ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি রুশ-পন্থী শহরগুলোর একটি এবং এটি এমন মাত্রায় ছিল যা আমার ধারণাতেও ছিল না," বলেন পোল্যান্ডে অবস্থিত নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোচান কনসাল্টিং এর প্রধান কনরাড মুজাইকা। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর রাশিয়া দাবি করছে যে তারা লুহান্সক অঞ্চলের ৯৩% এবং দনিয়েৎস্কের ৫৪% এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এখন এই পুরো অঞ্চলকে আয়ত্তে নিতে হলে রুশ প্রেসিডেন্টকে আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। এবং তিনি যদি একসময় বিজয় অর্জন করতেও সক্ষম হন, ওই অঞ্চল এতো বৃহৎ যে সেখানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে না। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ তুলেছেন যে তারা পূর্বাঞ্চলে গণহত্যা পরিচালনা করছে।
যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন পূর্বদিকের এসব অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ইউক্রেনের হাতে। বাকি অংশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরিচালনা করতো যারা সেখানে আট বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগেভাগে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটো এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাশিয়া যদি এই দুটো বৃহৎ অঞ্চল জয় করতে পারে, তাহলে প্রেসিডেন্ট পুতিন দেখাতে পারবেন যে এই যুদ্ধ থেকে তিনি কিছু একটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ডনবাসকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করে নেওয়া। ২০১৪ সালে বিতর্কিত এক গণভোটের মাধ্যমে ক্রাইমিয়াকে তিনি ঠিক যেভাবে রাশিয়ার অংশ করে নিয়েছেন। লুহান্সকে রাশিয়ার পুতুল-নেতা এর মধ্যেই "অদূর ভবিষ্যতে" সেখানে গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে কথা বলেছেন।
রাশিয়ার সৈন্যরা উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। "নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই অঞ্চল অনেক বৃহৎ। এছাড়াও এর ভৌগলিক জটিলতাকেও ছোট করে দেখা যাবে না," বলেন লন্ডনে কিংস কলেজে সংঘাত ও নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান।
সাত সপ্তাহের যুদ্ধের পরেও রাশিয়া তাদের সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখল করতে পারেনি। কিন্তু তারা ইজিওম শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলে প্রবেশের জন্য এই শহরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। "আপনি যদি দেখেন ইজিওমে তারা যা করছে, এখান দিয়েই প্রধান মহাসড়কগুলো গেছে, যার অর্থ হচ্ছে তারা তাদের যুদ্ধ-সামগ্রী এসব রাস্তা ও রেলপথে নিয়ে আসবে," বলেন অধ্যাপক জার্মান।
রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডনবাসের বিস্তৃত এলাকা প্রথমবারের মতো দখল করে নেওয়ার পর থেকে রাশিয়ার নিকটবর্তী শহরগুলোতে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ার এর পরের বড় টার্গেট হবে স্লোভিয়ান্সকের একটি সড়ক। এই শহরে সোয়া এক লাখ মানুষের বাস। রুশ-সমর্থিত বাহিনী ২০১৪ সালে শহরটি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়। রাশিয়ার আরো একটি বড় টার্গেট হবে দক্ষিণ দিকে ক্রামাটরস্ক শহর দখল করে নেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে ইউক্রেন যদি স্লোভিয়ান্সক শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে, তাহলে দুটো অঞ্চল দখলে রাশিয়ার অভিযান "ব্যর্থ হতে পারে।" লুহান্সক অঞ্চলে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা কয়েকটি শহরে রুশ সৈন্যরা পর্যায়ক্রমে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা সেভেরোদোনেস্কের কাছে রুবিঝনি শহর দখল করে নেওয়ার দাবি করেছে। লিসিচান্সক ও পপাসনা শহরেও তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে এসব শহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রাশিয়া পশ্চিম দিকে তাদের বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে যারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ইজিওম শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছে।
রাশিয়াকে সড়কপথে তাদের রসদ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সাথে ইউক্রেনের সৈন্যরা যাতে পশ্চিম থেকে রেলপথ দিয়ে আসতে না পারে সেজন্যও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে হবে। ইউক্রেনের সৈন্যদের চলাচল এবং ভারী যুদ্ধ-সামগ্রী বহনের জন্য জন্য সবচেয়ে উপযোগী পরিবহন হচ্ছে রেল। এছাড়াও বেসামরিক লোকজন সবচেয়ে দ্রুত এই পথেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যেতে পারে।
রুশ বাহিনী যদি এই রেল নেটওয়ার্কের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে এই পথ ধরে তাদের সৈন্যরা রসদসহ অগ্রসর হতে পারবে। আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের প্রধান সেরহি হাইদাই মনে করেন, রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে লুহান্সকের পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তে যাওয়ার পথে তাদের সামনে যতো প্রতিবন্ধকতা পড়বে সেগুলোকে ধ্বংস করা।
স্লোভিয়ান্সক শহর থেকে এখনও ট্রেন চলছে, তবে উত্তরের ইজিওম এবং দক্ষিণের মারিউপোল ও মোলিতোপল শহরের সঙ্গে ট্রেন-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ক্রামাটরস্ক থেকেও কোনো রেল চলছে না। ওই শহরের রেল স্টেশনে রকেট হামলায় অপেক্ষমাণ ৫৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর সেখান থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন