বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার তিন মাসাধিককাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত একজন কর্মীও মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারেনি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও, এমনকি মালয়েশিয়া লক্ষাধিক ভিসা প্রস্তুত করে রাখলেও কেন সেখানে কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়নি বা হচ্ছে না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ বন্ধ থাকার পর কথিত সমঝোতা স্মারকের সুবাদে বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। এতদিন পরে পাওয়া সুযোগ যত দ্রুত সম্ভব কাজে লাগানো উচিত ছিল। বিলম্ব হওয়াতে আমাদেরই বেশি ক্ষতির আশঙ্কা। এও হতে পারে, এই বিলম্বের কারণে বাজারটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। খবরে প্রকাশ, মালয়েশিয়ায় ইতোমধ্যে অন্য দেশ থেকে কর্মী নিয়োগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনার প্রকোপ কমায় অন্যান্য দেশের মতো মালয়েশিয়া তার উৎপাদন ও অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরকে গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষিসহ নানা ক্ষেত্রে তার বিদেশি কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে। সঙ্গতকারণেই সে বাংলাদেশের দিকে চেয়ে বসে থাকবে না। অন্যান্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় কর্মী আমদানি করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ বিলম্ব ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে হাতে পাওয়া সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, যা আদৌ কাম্য হতে পারে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, মালয়েশিয়া মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের তরফে বাংলাদেশকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে, সেখানে কর্মী প্রেরণের জন্য ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নির্বাচন করা হয়েছে। এই চিঠিটিই কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. ইমরান আহমাদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে প্রস্তুত রয়েছে। তবে ওই ২৫টি রিক্রটিং এজেন্সির তালিকা সম্বলিত চিঠিটি গ্রহণযোগ নয়। তাঁর মতে, এটি অনৈতিক একটি শর্ত, যা মানা যায় না। মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কমসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলে কাজের সুবিধা হয়। তুলনামূলকভাবে ভালো মনিটরিং যেমন সম্ভবপর হয়, তেমনি তাদের জবাবদিহি নিশ্চত করাও সহজ হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অনৈতিক কার্যকলাপ ও সিন্ডিকেটবাজির কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালে সরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় কর্মী প্রেরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ওই সমঝোতা স্মারক মোতাবেক বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠানোর সুযোগ লাভ করে। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটের অপকর্ম ও দুর্নীতি এ আয়োজন সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রতিপন্ন করে। তখন সরকার প্রতি কর্মী প্রেরণের খরচ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করলেও গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট তার স্থলে আদায় করে নেয় ৪ লাখ টাকা। কর্মী পাঠানোর ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া কর্মীদের অনেককে বিপদগ্রস্ত করে, পাচারের শিকার হিসেবে পরিণত করে। অতঃপর ২০১৮ সালে কর্মী প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। মালয়েশিয়ায় এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার খোলার জন্য গত বছরগুলোতে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হয়েছে। সেই লাগাতার চেষ্টার ফল হিসেবেই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দু’ দেশের মধ্যে আবারো একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যাতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বাধা দূর হয়। এর ফলে স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল, ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কর্মী প্রেরণ শুরু হবে। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কথা থেকেই তা বেরিয়ে এসেছে। ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির শর্তের বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হয়েছে কিনা, জানা যায়নি। অনেকের ধারণা, এদেশের যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, তাদেরই তালিকা করে পাঠানো হয়েছে। এটাও একটা সিন্ডিকেট হিসেবেই হয়তো কাজ করবে। আবার এ প্রসঙ্গে অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সি সব দেশে কর্মী প্রেরণ করে না। বাংলাাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠায় ৭টি এজেন্সি, জাপানে কর্মী পাঠায় ৪৫টি এজেন্সি এবং সউদী আরবে কর্মী পাঠায় ৫০০টি এজেন্সি। তাদের মতে, রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা সীমিত করা তাই এমন কোনো অন্যায্য কাজ নয়, যার অজুহাতে লোক পাঠানো বন্ধ রাখতে হবে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বাধা দূর হওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য সুখবর। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের একটি বড় শ্রমবাজার। কয়েক লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে সে দেশে কাজ করছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স মালয়েশিয়া থেকেই বাংলাদেশ পাচ্ছে । এতদিন বন্ধ না থাকলে আরো বহু কর্মী দেশটিতে যেতে পারতো। তাতে বেকারত্ব কমতো, রেমিট্যান্স বাড়তো। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীর বিশেষ চাহিদা ও কদর রয়েছে। আবার বাংলাদেশে বেকার কর্মীর সংখ্যাও প্রচুর। ফলে কর্মী নেওয়া বা পাঠানোর সূত্রে উভয় দেশই সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারে। কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে অবশ্য বাংলাদেশেরই অধিক গরজ থাকা স্বাভাবিক। কারণ, মালয়েশিয়া নেপাল, ভারত বা অন্যান্য দেশ থেকে তার প্রয়োজনীয় কর্মী সংগ্রহ করতে পারে। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে সে বাধ্য নয়। অবস্থানগত বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ ছিল। অনৈতিক শর্তের কথা বলে বসে থাকা মোটেই সঙ্গত নয়। এ নিয়ে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার এবং সেটা করতে হবে। কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু বা চলমান রেখেও আলোচনা চলতে পারে। যে কোনো সমস্যার সমাধানে আলাপ-আলোচনাই উপযুক্ত পথ। আলাপ-আলোচনা বন্ধ রাখলে সমাধান হবে না। আবার কর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেও কোনো ফল মিলবে না। বরং বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। সবদিক বিবেচনা করে বিষয়টির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে যে কোনো অনিশ্চয়তা ও অবলাবস্থা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ কর্মী পাঠানো দ্রুত, সহজ ও মসৃণ করা। এটা না করে সব রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষে দাঁড়ানো তার অপরিহার্য কর্তব্য নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন