আজকাল প্রায় প্রতিটি শিশুই সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠে। সেজন্য পারিবারিক পরিবেশ একটি শিশুর বেড়ে উঠার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অটিজম শব্দটির সাথে আমাদের দেশের অধিকাংশ মা-বাবাই জ্ঞাত না। অটিজম কোনো রোগের মধ্যে পড়ে না। তবে এটা একটা আচরণগত সমস্যা। অটিজম শিশুদের চাল-চলন স্বাভাবিক বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে। অটিজম একটি মস্তিষ্কের বিকাশগত সমস্যা হলেও রোগটি চিহ্নিত করা হয় শিশুদের প্রাত্যহিক কার্যকলাপ, যোগাযোগের দক্ষতা এবং বিকাশের ধারা থেকে।
অটিজম কী? এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। এই রোগের সাথে মানসিক প্রতিবন্ধকতা, জেদী ও আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভয় খিঁচুনী ইত্যাদি থাকতে পারে। অটিজমের কোনো জাদুকরী চিকিৎসা নেই। যত দ্রুত এই রোগটি শনাক্ত করা যায় এবং অটিস্টিক শিশুটিকে সঠিক শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায় তত তাড়াতাড়ি উন্নতি লাভ করা সম্ভব। অটিজম বাচ্চাদের মানসিক কিছু সমস্যা থাকে। যেমন: ১) ভাষাগত সমস্যা। ২) চোখে চোখে তাকায় না। ৩) সামাজিক কোনো যোগাযোগ থাকে না। ৪) পরিবেশ সম্বন্ধে বাস্তব ক্ষেত্রে মনোযোগ থাকে না। ৫) অন্যান্য মানুষের প্রতি মনোযোগ কম। ৬) অনেক শিশু একা একা থাকতে এবং নিজের মনে বিড় বিড় করতে পছন্দ করে। ৭) কোনো খেলনার প্রতি আকর্ষণ থাকে না, বরং বিভিন্ন ছোট খাটো জিনিস, যেমন: কলমের মুখ, ফিতা, ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। ৮) আবার কিছু কিছু অটিস্টিক শিশুর বাবা বা মা যে কোনো একজনের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। বিভিন্ন সময়ে এই শিশুরা বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করে থাকে।
বাড়িতে করণীয় কিছু কর্মসূচি: এই অটিজম শিশুদের বিশেষভাবে দৈনন্দিন পরিচর্যা করতে হয়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে রাত অবদি ওদের দৈনন্দিন কাজের একটা চার্ট করে দিতে হবে। কারণ, প্রতিটি মানুষের কিছু না কিছু কাজ থাকে। এদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সারাদিন ওরা অস্থিরতা করতে করতে ওদের দিন অতিবাহিত হচ্ছে। তাই ওদেরও কিছু অর্থপূর্ণ কাজ দিতে হবে। আপনার শিশুর খাটের পাশে বেল সিসটেম ঘড়ি রাখুন। যা শুনে সে বুঝতে পারে এখন ঘুম থেকে উঠার সময়। তারপর বাথরুমে নেবেন এবং মুখে বলবেন, বলো আমরা ‘সি’ দিব। দাঁত মাজবো। আমরা বিশেষ করে, মাকে বলি, দৈনন্দিন কাজগুলো আপনার শিশুকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করবেন। কীভাবে কাপড় পরবে বা নাস্তা খাবে ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোনটা পচা বা লজ্জা সেটা তাকে শেখাতে হবে এবং বলতে হবে মুখের ভাবভঙ্গির মাধ্যমে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ সেটা হলো ওর সাথে মাকে তার মতো অভিনয় করতে হবে। যেমন: পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এক সাথে গোল করে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই অটিস্টিক শিশুরা কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে থাকে। ১) আত্ম কেন্দ্রিক: এই স্তরের শিশু নিজেদের মধ্যে থাকে, একা খেলতে পছন্দ করে। অন্যের সাথে যোগাযোগ করার কোনো আগ্রহ তাদের থাকে না। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে কোনো তথ্য দিতে এবং গ্রহণ করতে পারে না। এরা কোনো নির্দেশ মানে না। এইসব শিশু মুখে বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে এবং এদের মধ্যে হাত ও পায়ের চলনের পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায়। ২) অনুরোধের স্তর: এই স্তরের শিশু খুব অল্প সময়ের জন্য বয়স্কদের সাথে যোগাযোগ করে। শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করে। ৩) যোগাযোগের স্তর: এই স্তরের শিশু পারিবারিক পরিবেশে পরিচিত মানুষের সাথে শুধু যোগাযোগ স্থাপন করে। পারিবারিক শব্দ এবং সাধারণ কিছু প্রশ্ন বুঝতে পারে। এই শিশুরা তাদের চাহিদা আঙুল দিয়ে দেখাতে সক্ষম হয় এবং শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চিনতে পারে।
এসব পর্যায়ের যে কোনো একটিতে হয়তো আপনার শিশুটির অবশ্যই থাকবে। অটিস্টিক শিশু নিজের মত থাকতে পছন্দ করে। কারো সাথে মিশতে চায় না। কিছু অটিস্টিক শিশু আছে নিজের হাত দিয়ে বাবা-মার হাত ধরতে চেষ্টা করে একটা স্বল্প যোগাযোগ করতে পছন্দ করে। আবার কোনো শিশু পার্টনারসিপ পছন্দ করে। অর্থাৎ ওর সাথে কেউ খেলায় অংশগ্রহণ করে সেটা সে চায় এবং পরক্ষণে সে বাচ্চাকে ধাক্কা দিয়ে আনন্দ অনুভব করে। আবার কোনো শিশুকে অনুরোধ করলে শুনে। যদি বলা হয় জুতাটা নিয়ে আসো, সে তখন হয়তো সহজে রেসপন্স করে না। তবে পরক্ষণে জুতাটা মাকে দিয়ে নিজের মনেই আনন্দ অনুভব করে।
কথা বলার জন্য কিছু করণীয়: শিশুদের সাথে সামনা সামনি কথা বলবেন। শিশুকে ইশারা, ইংগিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখান। শিশুকে আপনার চোখের দিকে তাকাতে ও ঠোঁটের নড়াচড়া অনুসরণ করতে সাহায্য করুন। ছবির বই, জিনিসপত্র ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখিয়ে কথা শেখান। শিশুকে অক্ষর ও ছড়া গানের অডিও ক্যাসেট শোনাতে পারেন। শেখানো কথাগুলো প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করুন ও তার সাথে নতুন শব্দ শেখানোর চেষ্টা করুন।
সামাজিক বিকাশ: শিশুকে সব রকম সামাজিক পরিবেশে নিয়ে যান। আত্মীয় স্বজনদের বাসায়, জন্মদিনে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে শিশু পার্কে এবং শপিং করতে। এই রূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে শিশুকে সাহায্য করুন। বাড়ির পরিবেশে কীভাবে খাপ খাবে এবং সময়ের সাথে প্রতিটি কাজে অভ্যস্ত করতে চেষ্টা করুন। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে এবং ভাবের আদান-প্রদান করতে শেখান। সামাজিক কিছু আদান-প্রদান করা শেখান। যেমন হাসির সাথে হাসতে পারা, আনন্দ প্রকাশ করতে পারা, সালাম করা, চোখে চোখে তাকিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা, শরীরের সাথে স্পর্শ করে বন্ধুত্ব করা ইত্যাদি। শিশুকে ওর বয়সের বুদ্ধির মান অনুযায়ী ব্যক্তিগত দক্ষতাগুলো শেখান। যেমন-যথাস্থানে প্রসাব-পায়খানা করা। নিজ হাতে খাওয়া, দাঁত মাজা, গোসল করা, জামা জুতো পরা, পেনসিল-কলম দিয়ে আঁকি-বুকি করা এবং দরকারি জিনিসগুলো ব্যবহার করা। শিশুর নিজস্ব কোনো প্রতিভা থাকলে অর্থাৎ গান শেখা, ছবি আঁকতে বা তার পছন্দের কোনো কাজকে সমর্থন করে প্রশিক্ষণ দেয়া। শিশুর কাজটি করতে বা শিখতে পারলে তাকে পুরস্কার দিন। শিশুর আচরণ অনুযায়ী একটি স্কুলে দিন তবে ঘরের প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকবে।
অটিস্টিক শিশুদের খাবারের তালিকা: অটিস্টিক শিশুদের খাদ্যাভাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুদের বাইরের ফাস্টফুড এড়িয়ে চলতে হবে। ইস্ট যুক্ত খাবার দেওয়া যাবে না। সামুদ্রিক মাছ, টিন জাতীয় খাবার, জুস, এড়িয়ে চলতে হবে। যতটুকু সম্ভব ঘরের তৈরি খাবার খাওয়াতে হবে। ১ হতে ৫ বছর এই বয়সে শিশুদের বেড়ে উঠার বয়স। সে সময়ে ওরা প্রত্যেকটি বয়সে ওদের মতো কাজ করতে পছন্দ করে। সুতরাং আপনার শিশুটি স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব মা-বাবার। শিশুর মনের গভীরে যেতে হবে এবং সে কী চায় জানতে হবে, বুঝতে হবে। সেভাবেই আমাদের শিশুদের পরিচর্যার জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশে উচ্চ শ্রেণীর পরিবারের শিশুরই অটিজম হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ অনেক পরিবারে বর্তমানে বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। সেক্ষেত্রে দেখা যায় সারাদিন বাচ্চাটা কাজের মেয়ের কাছে একা থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে অতি আদর যখন যেটা চাহিদা তার সেটাই পাচ্ছে বা বাইরের ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি, এসব শিশুদের আচরণগত অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়। তাই এসব থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন