পাকিস্তানের রাজনীতি নাটকীয় মোড় নিয়েছে। বিগত ৭৪ বছর ধরে দেশটির রাজনীতি যে গতিধারায় চলে আসছিল, ৭৩ বছর পর ৭৪ বছরের শেষে বা ৭৫ বছরের শুরুতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় নিয়েছে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকে প্যালেস ক্লিক বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দেশটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছিল। মাঝে মাঝে বিচার বিভাগও এই চক্রের সাথে হাত মেলায়। কিন্তু ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তানের রাজনীতি সার্প ইউটার্ন নিয়েছে। এখন একদিকে সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি, তাদের পেছনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের কতিপয় লোকাল এজেন্ট। অন্যদিকে ২২ কোটি মানুষের দেশের কোটি কোটি মানুষ। ইমরান খান যথার্থই বলেছেন, অতীতে পাকিস্তানের কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হলে জনগণ খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করতো। কিন্তু এবার আমি ক্ষমতাচ্যুত হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে এবং প্যালেস ক্লিক, মার্কিন সরকার এবং তাদের পদলেহী স্থানীয় মীর জাফর এবং মীর সাদিকদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ইমরানের পক্ষে কোটি জনতার সমর্থনের বিষয়টি আমরা এই কলামের পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো।
আসলে পাকিস্তানের যাত্রাটিই শুরু হয় ভুল পথে এবং ভুল ধারণার ওপর। ভারত বিভক্তির পর থেকেই কাশ্মীর ইস্যুটি অমীমাংসিত থাকায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা শুরু হয়। সেই বৈরিতা আজও আছে। কাশ্মীর প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি। ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বড় রাষ্ট্র। আয়তন পাকিস্তানের ৪ গুণেরও বেশি। লোক সংখ্যা ৫ গুণ বেশি। সেই অনুপাতে তার সামরিক বাহিনী। ভারত বিভক্তির সময় ব্রিটিশ আমলে যে সামরিক বাহিনী ছিল তার সিংহভাগ পেয়েছে ভারত। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের তরবারি সব সময়েই পাকিস্তানের মাথার ওপর ঝুলছিল।
এই অবস্থায় ভারত বিভক্তির প্রথম যুগে পাকিস্তান মনে করে যে, কাশ্মীর নিয়ে যদি কোনো সংঘর্ষ হয়, তাহলে পাকিস্তান তার পাশে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বকে পাবে। এজন্য বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন ১৯৫৪ পাক-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আরো দুইটি সামরিক জোটে জড়িয়ে পড়ে। একটি হলো বাগদাদ চুক্তি বা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো)। ১৯৫৫ সালে স্বাক্ষরিত বাগদাদ চুক্তির অপর সদস্যরা হলো, ইরান, তুরস্ক এবং ইংল্যান্ড। ১৯৫৫ সালে স্বাক্ষরিত অপর একটি সামরিক জোটের নাম সিয়াটো বা দক্ষিণ পূর্ব এশীয় চুক্তি সংস্থা। এই সংস্থার অন্যান্য সদস্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ফিলিপাইন্স, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ড।
পাকিস্তান আমেরিকান ক্যাম্পে ঢুকে পড়লে ভারতও সাবেক সোভিয়েট ক্যাম্পে কাতারবন্দী হয়। অবশ্য ভারত পাকিস্তানের মতো সোভিয়েট শিবিরে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়নি। মিশর ও যুগোশ্লাভিয়াসহ ১২০টি দেশ নিয়ে জোট নিরপেক্ষ শিবির গঠিত হয়। এই শিবিরের আরো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলো ইন্দোনেশিয়া এবং ঘানা। নেতৃবৃন্দ হলেন পন্ডিত জওহর লাল নেহ্রু, মিশরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল জামাল আব্দুন নাসের, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোশেফ ব্রোজ টিটো, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ডক্টর আহমদ সুকর্ণ এবং ঘানার প্রেসিডেন্ট ড. এনক্রুমা। নামে জোট নিরপেক্ষ হলেও কামে তারা মার্কিন বিরোধী এবং সোভিয়েটপন্থী ছিল।
॥দুই॥
ভারত-পাকিস্তান বৈরিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাওয়ার প্রত্যাশায় পাকিস্তান তিন তিনটি সামরিক চুক্তিতে জড়িত হলেও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং আমেরিকা পাকিস্তানকে এই বলে থামানোর চেষ্টা করেছে যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে যেসব সমরাস্ত্র দিয়েছে, সেগুলো কমিউনিজম ঠেকানোর জন্য, ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নয়। ভারত যেখানে সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে মিগ-২৯ জঙ্গী বিমানসহ সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র পেয়েছে সেখানে পাকিস্তানকে আমেরিকা দিয়েছে ৪০ দশকের প্যাটন ট্যাংক এবং বুড়ো হয়ে যাওয়া এফ-৮৬ স্যাবর জেট ফাইটার। বাংলাদেশকে নিয়ে সংঘটিত যুদ্ধেও দেখা গেছে, ভারতীয় মিগ-২১ এর কাছে পাকিস্তানি স্যাবর এফ-৮৬ শিশুর মতো। এই দুইটি জঙ্গী বিমানের ডগ ফাইট দেখে একজন পশ্চিমা সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, একটি বেবি ট্যাক্সি (স্যাবর এফ-৮৬) একটি মোটর গাড়ির (মিগ-২১) পিছু ছুটেছে।
মার্কিন ক্যাম্পে পাকিস্তানের ভিড়ে যাওয়ায় এবং ৪/৫ যুগ অবস্থান করায় পাকিস্তানের ক্ষতি হয়েছে এই যে, এত সুদীর্ঘ সাহচর্যের ফলে তারা পাকিস্তানের সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন এবং তাদের অধীনস্থ ইনস্টিটিউশনে ব্যাপক ও গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। পর্দার অন্তরালে এই অনুপ্রবেশ ঘটে বলে রাজনীতিকেও তারা নেপথ্য থেকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। সিভিল মিলিটারি চক্র এবং তাদের বিদেশি মেন্টর আমেরিকা মিলে পাকিস্তানে যে একটি অশুভ শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে তারা কোনোদিন পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে দেয়নি। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের জীবনে ২৯ জন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। কিন্তু কেউই ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
এদের মধ্যে ৪ জনের অপঘাত মৃত্যু হয়েছে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে জনসভায় বক্তৃতাকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ১৯৭৪ সালে ভারত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোও অ্যাটম বোমা বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরী কিসিঞ্জার এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে বলে ভুট্টোকে হুমকি দেন। ১৯৭৯ সালে সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি হিসেবে ভুট্টোকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে হয়। ১৯৮৮ সালে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকও নিহত হন। ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় বক্তৃতা শেষ করে মোটর গাড়িতে ওঠার সময় আততায়ীর দুইটি বুলেট এবং একটি বোমা বিস্ফোরণে জেড এ ভুট্টোর কন্যা প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো নিহত হন। এই ৪টি মৃত্যুর কোনটিরই রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।
॥তিন॥
এই ৪টি হত্যাকাণ্ড ছাড়াও পাকিস্তানের ৭ জন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন (উরংসরংংবফ) হয় গভর্নর জেনারেল অথবা প্রেসিডেন্ট। এই ৭ জন প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী (পদত্যাগ করতে বাধ্য হন), মালিক ফিরোজ খান নূন, মোহাম্মদ খান জুনেজো, বেনজীর ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ (একবার সামরিক অভ্যুত্থানে, আরেকবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে)।
আমি শুরুতে বলেছি যে, পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে শেকড়ই গজাতে দেওয়া হয়নি। ওপরে বিধৃত বিবরণ সেটা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করে। যে ট্রেন্ড চলে আসছে বিগত ৭২ বছর ধরে, সেই ট্রেন্ডের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছেন ইমরান খান। ইমরান খানের ক্ষেত্রে ঘটনাবলী ভুট্টোর মতো খাপে খাপে মিলে না গেলেও অনেকটাই মিল লক্ষ করা যাচ্ছে। পদচ্যুত হওয়ার পর ভুট্টোর জনপ্রিয়তা যেমন আকাশছোঁয়া হয়েছিল, ইমরান খানের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, তার জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী হচ্ছে। বাংলাদেশের দুই-একটি বাদে প্রায় সবকটি গণমাধ্যমে ইমরান খানের বলতে গেলে খবরই পাওয়া যায় না। কিন্তু পাকিস্তানের জিও নিউজ, ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ইন্টারনেটে পড়া যায়। চলতি সংকটকালে ইমরান খানের সমর্থনে তিনটি সমাবেশ হয়েছে। তিনটিতেই লক্ষ মানুষের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। একটি ২৭ মার্চ ইসলামাবাদে। দ্বিতীয়টি দ্বিতীয় রমজানে বাদ এশায়। বাদ এশায় পাকিস্তানের কমপক্ষে ৪০টি শহরের সমাবেশে রাতেও হাজার হাজার মানুষ। তৃতীয়টি ১২ এপ্রিল রবিবার পেশোয়ারে। পেশোয়ারে জনসমাগম এত বিপুল ছিল যে আকাশ থেকে সেই জনসমাবেশের ছবি তুলতে হয়েছে।
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ঐ ধরনের নিউজ বা ছবি প্রকাশিত না হলেও ১২ এপ্রিল ‘দৈনিক প্রথম আলোতে’ একটি উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। লিখেছেন পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক সারফুদ্দিন আহমদ। শিরোনাম, ‘গদি হারা ইমরানের জন্য রাজপথে এত মানুষ কেন?’ নিবন্ধটির এক স্থানে লেখা হয়েছে, ‘রবিবার দিবাগত রাতে করাচি, পেশোয়ার, মুলতান, খানেওয়াল, খাইবার ইসলামাবাদ, লাহোর, অ্যাবোটাবাদসহ বিভিন্ন শহরে ইমরানের সমর্থনে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নামার পর সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই বিক্ষোভকারীদের সবাই যে ইমরানের দলের কর্মী সমর্থক, তা নয়। এসব বিক্ষোভকারী প্রায় সবাই মনে করছেন, ইমরানকে আমেরিকার চক্রান্তে ফাঁসানো হয়েছে। আমেরিকার ইশারাতেই ইমরানের শরিকরা গাদ্দারি করে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এটিকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য তারা হুমকি মনে করছেন।’
অতঃপর পত্রিকাটি লিখেছে, ‘দুর্বৃত্তদের নেতৃত্বে আমদানি করা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের ইতিহাসে এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত সংখ্যক মানুষ কখনই নামেনি। ইমরানের এই কথায় ভুল কিছু নাই। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এভাবে এত লোক কোনো গদি হারানো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এবং আমদানি করা সরকার বসানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি।’
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইমরানের বৈঠকের সময় তাকে হাতে তসবিহ টিপতে দেখা গেছে। পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মানুষ একে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে দেখেছেন।’
অনাস্থা প্রস্তাবের পর ইমরানের সাবেক সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আলী মোহাম্মদ খান বলেছিলেন, (প্রথম আলোর ঐ উপ-সম্পাদকীয় মোতাবেক), ‘রুশ ইস্যু আসলে অজুহাত। ইমরান খানের অপরাধ ছিল, তিনি মুসলিম ব্লক বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। তিনি খতমে নবুয়তের কথা বলেছিলেন। ইসলামী হুকুমতের কথা বলেছেন। মদিনা সনদের কথা বলেছেন। এটা ইমরানের সাময়িক পরাজয়। ময়দানে কারবালায় হোসেনের সাময়িক পরাজয় হয়েছিল। কিন্তু দুনিয়া তাকেই মনে রেখেছে। সাময়িক বিদায় ইমরানকে জনপ্রিয়তার যে নতুন মাত্রায় নিয়েছে আপাতত সেটিই তাঁর প্রাপ্তি।’
ক্রিকেটের মাঠে তিনি যেমন ছিলেন ‘লড়াকু কাপ্তান’, রাজনীতির মাঠেও এবার তিনি আবির্ভূত হয়েছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জন অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু নেতা হিসেবে। ইতোমধ্যেই তিনি প্রমাণ করেছেন, সিভিল-মিলিটারি চক্র এবং তাদের মদদদাতা মার্কিনীদের রক্তচক্ষুকে তিনি ভয় করেন না। আগামী দিন ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তানে কি গণঅভ্যুত্থান ঘটবে? আগামী দেড় বছরের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এসপার ওসপার একটা কিছু ঘটবে।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, গত ১৬ এপ্রিল করাচিতে ইমরানের যে জনসভা হয় সেখানেও তারাবীর নামাজ পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাবেত হয়। এই নিবন্ধে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে সেটি করাচির জনসভার লক্ষ লক্ষ মানুষের একটি অংশ।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন