রমজান মাসে ঢাকার ব্যস্ততম নিউমার্কেট এলাকার হকার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা ঘটল। গত সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ মঙ্গলবার সারাদিন ধরে থেমে থেমে অব্যাহত ছিল। এ সময়ে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, এলিফ্যান্ট রোড, গাউছিয়া মার্কেটসহ আশপাশের ২০টি মার্কেট কার্যত বন্ধ ছিল। সংর্ঘষে প্রতিপক্ষের ইটপাটকেল এবং পুলিশের টিয়ারশেল, রাবার বুলেটে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত, অন্তত একজনের মৃত্যু আরো একাধিক ব্যক্তির আশঙ্কাজনক অবস্থার কথা জানা যায়। সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে ব্যস্ততম ঢাকা-ময়নসিংহ সড়কসহ আশপাশের সব রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পুরনো ঢাকা ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে সমগ্র শহরে যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকায় ভুতুড়ে যুদ্ধাবস্থা দেখে মনে হয়েছে সবকিছু যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অথচ ব্যবসায়ী, হকার, শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগসহ কোনো পক্ষই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।
ঢাকা কলেজসহ ওই এলাকায় বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী ও মার্কেট-ফুটপাতের হকারদের সংঘাতের ঘটনা নতুন নয়। গতকাল ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ শিরোনাম ছিল নিউ মার্কেট এলাকায় দোকানদার ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সংর্ঘষের ঘটনাটি। নীলক্ষেত নিউমার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থী ও দোকানদার-কর্মচারীরা প্রায়শ বিতণ্ডা ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও পুরো এলাকা এমন রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার নজির কয়েক বছর পর পর দেখা গেল। একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সাথে দোকানদার-হকারদের সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। ২০১২ সালে পরনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে চশমার মার্কেটে চশমা কিনে মূল্য পরিশোধ না করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয়াবহ সংর্ঘষের সূত্রপাত হয়। সংর্ঘষের মাঝখানে পড়ে সুনীল ঘোষ নামের একজনের মৃত্যু এবং বেশ কয়েকজন ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়েছিল। সোম-মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকার সংর্ঘষের ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে গিয়ে অপদস্ত হয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আধিপত্য বিস্তার, বিনা পয়সায় খাওয়া কিংবা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কারণে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এমন অহেতুক সংঘাত-সংর্ঘষের জন্ম দিক, এটা কারো কাম্য নয়। শুধু ছাত্রলীগের উপর দোষ চাপানোও সংগত নয়। একশ্রেণির দোকান মালিক ও ফুটপাতের হকারও রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার কারণে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত মতামতে নিউমার্কেট, গাউছিয়া-চন্দ্রিমা-নুরজাহান মার্কেটসহ এ এলাকার সবগুলো মার্কেটের দোকান কর্মচারীদের আচরণে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অসন্তোষের কথা উঠে এসেছে।
করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে ব্যবসা করতে পারেনি নিউ মার্কেটসহ শপিংমলের ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় এবার ভালো ব্যবসা করার প্রত্যাশা সকলের। তবে অতিরিক্ত মূল্য হাকিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা অনৈতিক ও অনভিপ্রেত। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রায়শ উঠতে দেখা যায়। অন্যদিকে ফুটপাতে চাঁদাবাজিসহ অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেয়ার প্রতিযোগিতা থেকে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরত থাকতে হবে। তাদের বিরত রাখতে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর নির্দেশনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী বিপনীবিতান নিউ মার্কেট-গাউছিয়ার আশপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, সিটি কলেজসহ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে ২০টির বেশি মার্কেট ও ফুটপাতে ব্যবসার উপর হাজার হাজার কর্মচারী ও হকারের আয়-রোজগার নির্ভরশীল। কিছু সংখ্যক চাঁদাবাজ ও অনৈতিক আধিপত্যকামী ছাত্র নেতা ও বেপরোয়া হকার-দোকানকর্মীর কারণে শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান কাম্য নয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে স্বচ্ছ ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে পক্ষপাতহীন স্বচ্ছ ভূমিকা পালন করতে হবে। ঘটনা শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও সংঘাত ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা বিতর্কিত ভূমিকা ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেয়া দরকার। নিউ মার্কেট এলাকার হাজার হাজার দোকান মালিক-কর্মচারী ও ফুটপাতের হকারদের বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি যে কোনো পক্ষের বেপরোয়া ও অনৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন