রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো। রোগ হলে রোগীর কষ্ট, চিকিৎসা, ওষুধ ইত্যাদিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর এমন একটি প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে যা বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘নো ইউর হেলথ সার্ভিসেস’ যার অর্থ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। আমাদের দেশে পানিবাহিত রোগ সারা বছরব্যাপিই থাকে। তবে কোনো কোনো মৌসুমে এই রোগ প্রকট রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাস অর্থাৎ এই সময়ে নানা বয়সের মানুষ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। রমজানের আগ থেকেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষের সচেতনতা ও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
গরম আসতে না আসতেই পানি সঙ্কটের পাশাপাশি ভ্যাপসা গরমের কারণে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে, বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। শুধু বয়স্করাই আক্রান্ত হচ্ছে না, বয়স্কদের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে মধ্য বয়স্ক থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চরাও। এই অবস্থায় প্রতিদিন ১২ শতাধিক রোগী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সংস্থাটি ইতোমধ্যেই জানিয়েছে এদের বড় একটি অংশ পানি বাহিত কলেরায় আক্রান্ত।
ডায়রিয়া হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দূষিত পানি পান করা। বাংলাদেশে মানুষের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই তীব্র। এদিকে চলছে গ্রীষ্মকাল। আর এই গ্রীষ্মকালে দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। ফলে এই সময়টাতে ডায়রিয়া রোগে আক্রন্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও গ্রীষ্মকালে রান্না করা খাবার খুব দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়, দ্রুতই জীবাণু বংশবিস্তার করে। ফলে সেই পচা-বাসি খাবার খাওয়ায় মানুষ ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গরমে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণের মাত্রা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি হয় বলে খোলা খাবার, রেস্তোরাঁর খাবার খেয়ে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হয়। প্রচণ্ড রোদ আর গরমের কারণে পিপাসা পায় এবং মানুষ বাইরের খোলা পানি, শরবত, জুস ইত্যাদি পান করে থাকেন, তবে পানি বিশুদ্ধ কিনা সেটা অনেকেই যাচাই করে না। সাধারণত এসব কারণ গুলোর জন্যই এ সময়টাতে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়।
বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সংক্রামণ প্রতিরোধ করতে চারটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যেমন-সাবান, নিরবিচ্ছিন্ন বিশুদ্ধ পানি, হাত জীবাণুমুক্ত করতে আলকোহলমিশ্রিত উপাদান, গ্লাভস এবং জীবাণুমুক্ত ধারালো সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। তবে সব কিছুরই যেমন সমাধান রয়েছে, ঠিক তেমনই ডায়রিয়ারও রয়েছে প্রতিরোধ ও প্রতিকার। প্রথমেই বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন দেহে পানির চাহিদা অন্তত ২-৩ লিটার। তবে সেটা অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় বিশুদ্ধ পানির অভাব তাই পানি ফুটিয়ে তারপর ঠাণ্ডা করে রাখা সহজ এবং সাশ্রয়ী। অনেকে চাইলে পানির ফিল্টারও ব্যবহার করতে পারেন। তবে পানি ফুটালে সব ধরনের জীবাণুই ধ্বংস হয়। তাই ফুটিয়ে খাওয়া হয় সবচাইতে নিরাপদ। এছাড়াও ঘরের বাইরে, বিশেষ করে রাস্তায় বিক্রি করা শরবত, জুস বা অন্যান্য পানীয় পান থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে প্যাকেটজাত পানীয় পান করতে পারেন। বাইরে বের হওয়ার সময় বাসা থেকে ফুটানো বা পরিশোধনকৃত পানি বহন করতে পারেন।
কর্মজীবি মানুষেদের বেশিরভাগ সময়েই বাইরে থাকতে হয়। তাই দেখা দিতে পারে পানিশূন্যতা। এই পানিশূন্যতা থেকে বাঁচতে পান করতে হবে খাবার স্যালাইন। এতে বাড়বে কর্মশক্তি, থাকা যাবে সুস্থও। খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও অবলম্বন করতে হবে যথেষ্ট সাবধানতা। বাইরের খোলা খাবার পরিহার করতে হবে, বাসি-পচা খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। আর যদি বাসি খাবার খেতে চান তাহলে ভালো করে গরম করে খেতে হবে। তবে না খাওয়াটাই উত্তম। খাবার খাওয়ার পূর্বে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বাইরে থেকে আনা ফল-মূল এবং শাক-সবজি ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর নজর দিতে হবে।
সর্বোপরি জনসচেতনতা ও দ্রুত চিকিৎসার মতো পদক্ষেপই পারে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে। তাই খাবার গ্রহণের আগে হাত মুখ ভাল করে পরিষ্কার করা জরুরি। মনে রাখবেন- মলমূত্র ত্যাগের পর হাত ভাল করে সাবান / ছাই / মাটি দিয়ে পরিষ্কার করা দরকার। পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত।
মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট।
মোবা: ০১৭১৬-২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন