৭ এপ্রিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমগ্র বিশ্বে দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উদযাপিত হয়েছে। ২০২২ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য “আওয়ার প্লানেট, আওয়ার হেলথ”। অর্থাৎ ‘সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য’। আর এই নিশ্চিত স্বাস্থ্যের জন্য সংক্রামক রোগের সাথে সাথে অসংক্রামক রোগের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।
সংক্রামক রোগ বর্তমান বিশ্বে একটি অত্যন্ত পরিচিত বিষয়। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবার পর সংক্রামক রোগের বিষয়ে মানুষ আরো বেশি সচেতন হয়েছেন এবং এই বিষয়ে জানতে পেরেছেন। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সমগ্র বিশ্বে মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি অধিকতর সচেতন হয়েছে। যদিও বর্তমানে বিশ্বে করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের হার হ্রাস পেয়েছে, তারপরেও অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। কারণ মাস্ক পরার মাধ্যমে অনেক সংক্রামক রোগকে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সত্যি কথা বলতে ‘সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য’ এই প্রতিপাদ্য বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে যেমন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে একইভাবে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায়ও সর্বদাই সচেতন থাকতে হবে। এবারে প্রথমে আমি সংক্রামক রোগ, বিশেষ করে করোনা ভাইরাস নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করছি। পৃথিবীতে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ এ অর্ধশত কোটি মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং অর্ধকোটির বেশি মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং সরকারি হিসাবে এই ভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার জন। বলতে গেলে এই ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে একপ্রকার অচল করে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এই ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আশার বিষয় হলো আল্লাহর রহমত ও ত্বড়িত পদক্ষেপের কারণে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে, সাথে সাথে এই ভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশ্বে স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশকে অনেকটাই মুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। আরেকটি বড় বিষয় হলো করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধমূলক টিকাদানের ব্যবস্থা করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলাদেশ ১ দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়ে বিশ্বের মধ্যে টিকাদানের ক্ষেত্রে অন্যতম সফল দেশ হিসেবে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এটা বাংলাদেশে মানুষের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও গৌরবের বিষয়। চিকিৎসক সমাজ, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে রোগীদের সেবা দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করছেন, অনেকে জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। আমি তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এবারে অসংক্রামক রোগ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক রোগের কারণে বছরে ৭ কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়। যা মোট মৃত্যুর তিন ভাগের দুই ভাগ। একারণেই আমাদের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। উল্লেখযোগ্য অসংক্রামক রোগের মধ্যে রয়েছে হার্টএট্যাকসহ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনী রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘ মেয়াদী রোগ, মানসিক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিক এসিড, গ্যাস্টিক, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধুমপান ও তামাক জাতীয় দ্রব্য পরিহার করা, কোমল পানীয় ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার সম্ভব হলে পরিহার করা, বিশুদ্ধ পানি সেবনে অধিক গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। সাথে সাথে সবুজ শাক সবজি, ফলমূল, ছোট মাছ, ছোট মুরগীর মাংস, ডিমের সাদা অংশ, লাল চাল ও লাল আটা ইত্যাদির খাবারের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্বের সকল দেশে সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে একটি বড় বাধা হলো বৈষম্য। আমরা একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। কিছু মানুষ স্বাস্থ্যকর উন্নত জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্য জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে নিরন্তর। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, আবাসন সংকট প্রকট, শিক্ষার ক্ষেত্রে সীমিত সুযোগ, সংকটাপন্ন স্বাস্থ্য পরিসেবা, বৃহত্তর লিঙ্গ বৈষম্য, নিরাপদ পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি- নির্মল বায়ু ও নিরাপদ খাদ্য সংকটসহ বিবিধ সমস্যা বিদ্যমান। এই সকল সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
পরিশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২২ এর সফলতা কামনা করছি। গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যে সকল কর্মসূচী নিয়েছে তার সফলতা কামনা করে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিরাময়, নির্মূলের মাধ্যমে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সকল বাধা বৈষম্য দূর করে সবার জন্য একটি সুন্দর স্বাস্থ্যকর বিশ্ব নিশ্চিত করব এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও
কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন