সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরোধী অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এগুলোকে অনেকে বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য করলেও এর পেছনে সুদূরপ্রসারী অপচেষ্টা যে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। হিজাব পরা নিয়ে শিক্ষিকার ছাত্রীদের পেটানো, রাসূল (স.) কে নিয়ে শিক্ষকের কটুক্তি, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে একই বিষয় নিয়ে পোস্ট দেয়া ইত্যাদি স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে এলাকাভিত্তিক যেমন উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তেমনি জাতীয়ভাবেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কিছুদিন আগে তেজগাও কলেজের এক শিক্ষিকাকে টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ কনস্টেবলের মন্তব্যের জেরে সংসদ থেকে শুরু করে সর্বত্র তোলপাড় শুরু হলেও আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি এবং প্রিয় নবীকে (স.) নিয়ে যখন কেউ বিরূপ মন্তব্য করে, তখন এ নিয়ে সংসদে বা বাইরে তথাকথিত প্রগতিশীলদের কাউকে ব্যানার-মিছিল নিয়ে হাজির কিংবা প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। এটা তাদের দ্বিচারিতা ছাড়া আর কি হতে পারে! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তোমরা অপরের ধর্মকে গালি দিও না। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কিন্তু আল্লাহর এ নির্দেশ সবসময়ই মেনে চলে এবং হাজার বছর ধরে মেনে চলেছে। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই যার যার স্বাধীনমতো ধর্ম পালন করছে। কখনো কখনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা যে ঘটনে না, তা নয়। এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। কিংবা একে অন্যকে ফাঁসানোর দুরভিসন্ধিও এর মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক নয়। তখন কিন্তু তা নিয়ে সুশীলরা বেশ সোচ্চার হয়ে উঠে। অন্যদিকে, আমাদের ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে যখন কেউ কটাক্ষ করে, তখন তারা চুপ মেরে থাকে। তাহলে কি দাঁড়াল? অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটলে সোচ্চার হয়ে উঠব, আর নিজের ধর্মের ক্ষেত্রে ঘটলে চুপ করে থাকব, এই তো? এমন নীতি অবলম্বন করে কি তারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে চাইছে বা লেবাস পরতে চাইছে? বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতা বলে যে কিছু নেই, এ বিষয়টি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। জানলেও তা স্পষ্ট করছে না। কারণ, স্পষ্ট করলেই নাস্তিকতার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়বে। সরল অর্থে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, সে কোনো ধর্মেরই নয়। সে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং তা পালনও করে না। ধর্ম পালন বা ধর্মধারী হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা চরম ভন্ডামি ছাড়া কিছু নয়। এই যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তি এবং অসহনীশলতা তা কি ধর্ম নিরপেক্ষতার মধ্যে পড়ে? ভারতে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা নিয়ে তোলপাড় হলো এবং নিষিদ্ধ করা হলো, মুসলমানদের ধর্মপালনে নানাভাবে বাধা দেয়াসহ হত্যা নিপীড়ন করা হচ্ছে, তা হিন্দু ধর্মবলম্বীরাই করছে, ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন কেউ করছে না। ধর্মের পক্ষের লোকজনই করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব ব্যাপী বিভিন্ন ধর্মের মিশনারি রয়েছে। যার যার ধর্ম অনুযায়ী, অপরকে দাওয়াত দেয় বা অনুসারী হতে উৎসাহী করে তুলে। আমাদের দেশেও মিশনারী রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে হিন্দু সংগঠন ইসকন বেশ জোরেসোরে তৎপরতা চালাচ্ছে। এরকম বিভিন্ন দেশেও রয়েছে। মুসলমানরাও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার জন্য মানুষকে আহ্বান জানায়। এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। তবে অস্বাভাবিক যে, আমাদের দেশে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে চুন থেকে পান খসলে একটি শ্রেণীর সোচ্চার হয়ে ওঠা এবং নিজের ধর্মকে আঘাত করলে চুপ থাকার বিষয়টি নিয়ে তাদের ন্যায্যতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটা দিয়ে তারা বোঝাতে চাইছে তারা ধর্মনিরপেক্ষ। এটা তাদের চাতুরি ছাড়া কিছইু নয়।
দুই.
৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে মুসলমান অধ্যুষিত দেশ বলা স্বাভাবিক। এটা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হিন্দু প্রধান দেশ হিসেবে ভারত হিন্দু রাষ্ট্র বৌদ্ধ প্রধান দেশ হিসেবে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভূটান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া বৌদ্ধ দেশ হিসেবে গণ্য হবে এটাও স্বাভাবিক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্ম প্রধান দেশও খ্রিস্টানদের দেশ হিসেবে পরিচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপরই একটি দেশের মূল পরিচিতি গড়ে উঠে। স্ব স্ব দেশের সরকারকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। পৃথিবীতে খুব কম রাষ্ট্রই আছে, যারা সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। বরং তারা সব ধর্মের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে। তারা ভালো করেই জানে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। আমাদের দেশে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, এ কথা বলার পেছনে তাদের নাস্তিক্যবাদ রয়েছে। অথচ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মূল্যবোধ বাদ দিয়ে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, তাদের আগে চিন্তা করতে হবে তাদের এ আহ্বান দেশের মানুষ মানবে কিনা? যে ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে, সে কি পেরেছে তা বজায় রাখতে? পারেনি। ঐতিহাসিকভাবেও তা সম্ভব হয়নি। দ্বিজাতি তত্ত্ব বা হিন্দু মুসলমানের আলাদা হওয়ার ভিত্তিতেই কিন্তু দেশ ভাগ হয়েছিল। ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানে এখন হিন্দুদের রামরাজত্ব চলছে। নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদের এমনই ধুয়ো তুলেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাতে বিপুল উৎসাহ দেখাচ্ছে। ভারতকে ‘হিন্দুস্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। বিশ্বের আর কোনো দেশ এভাবে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশকে ডাকে না। অথচ আমাদের দেশে একটি শ্রেণী ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মূলত বর্তমান সরকারের আমলেই তাদের তৎপরতা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সঠিকভাবে না জেনে কিংবা জেনে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মহীনতার দিকে ধাবিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে অতীতে কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়নি। এটি মুসলমান রাষ্ট্র এবং এখানে শুধু মুসলমানরাই থাকবে-এমন কথাও কখনো উচ্চারিত হয়নি। হঠাৎ করেই যেন বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে অবজ্ঞা করার একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি কি? কয়েক দিন আগে এক ধর্মনিরপেক্ষবাদীকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি যথাযথভাবে উত্তর দিতে পারলেন না। তাকে বললাম, আপনারা যাকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বলেন তা হচ্ছে, ‘ধর্মহীনতা’। তিনি চটাং করে লাফিয়ে উঠে বললেন, আপনার এ কথাটি সঠিক নয়। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কি বুঝিয়ে দেন। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। আমি বললাম, ‘নিরপেক্ষ’ তো সেটাই যা কোনো কিছুকেই সমর্থন করে না। ‘কোনো কিছুরই পক্ষে নয়’? ব্যক্তি, মতামত, ধর্ম-এসবের কোনোটিরই পক্ষে নয়। ধর্মের ক্ষেত্রে যদি ধরা হয়, তাহলে আমার ধর্ম নাই। তিনি বেশ জোর গলায় বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়টি ঠিক এ অর্থে বোঝায় না। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কোন অর্থে বোঝায়? আপনি যদি ‘নিরপেক্ষ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে তো আপনি নিজের সাথে ছাড়া কারো সাথেই নেই। তখন এটা আপনার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সামষ্টিক কোনো বিষয় নয়। তবে এটা ঠিক, আপনার একটা পক্ষ আছে। এমনকি যে ব্যক্তি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ কথা বলে, তারও একটা ধর্ম আছে (নাস্তিক হলেও সেটা তার একটা নীতি বা একটা পক্ষ)। তিনি বললেন, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা অর্থে বোঝায় না। আমি তাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে বলুন। তিনি এর জবাব দিতে পারেননি। তাকে বললাম, আপনারা যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তারা একটা হুজুগের মধ্যে আছেন। একটা সময় ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি বেশ হুজুগ সৃষ্টি করেছিল। কয়েক দশক ধরে কিছু মানুষ তাতে মেতে ছিল। তাদের ঘুম ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। এক সময় দেখল সেক্যুলারিজমের ওপর ভিত্তি করে যেসব দেশ ও সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা খানখান হয়ে গেছে। মানুষ যার যার ধর্মের দিকে ফিরে গেছে। তারা বুঝতে পারছে, ধর্মছাড়া কিছুকাল যেমন খুশি তেমন চলা যায়। এক সময় হতাশায় পেয়ে বসে। অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। আক্ষরিক অর্থে ধর্মহীনতা কোনো জীবনবিধান হতে পারে না। ধর্মই মানুষকে সুশৃঙ্খল এবং শান্তির জীবনযাপন করতে সহায়তা করে। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা না বলে বলুন, যার যার ধর্ম সে সে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পালন করুক। আপনারা যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে ধর্মহীনতা না বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে শব্দটি বদলে ফেলুন। অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করুণ। আমাদের দেশের কিছু লোক ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অতি প্রগতিশীল বা আধুনিক হতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। হুজুগের মধ্যে পড়ে অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের কথা, এমনকি নিজের পরিবারের ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা ভুলে ধর্মের বাইরে চলতে চাইছে। ধর্মের কথা বললেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে। এর কারণ হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বা প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বা একে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাশ কাটানো যায় এবং বেলেল্লাপানাসহ অশ্লীল যত কাজ আছে তা করা যায়। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সূক্ষ্মভাবে ধর্মহীনতার বিষয়টি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে দুঃখের বিষয়, তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আমরা কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কথা বলব? যে দেশের মানুষ কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি এবং পারস্পরিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতির মাধ্যমে চিরকাল বসবাস করে আসছে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তাদের এই বিশ্বাস এবং ব্যবস্থায় আঘাত করার জন্য একটি গোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছে। বিভিন্ন সময়ে ইসলামন ধর্ম ও রাসূলকে নিয়ে কুটুক্তি এবং হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুর করে একটি প্লট সাজিয়ে ঐ সব ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বোঝাতে চাইছে, ধর্ম থাকলে এমন হবে। ধর্ম না থাকলে এসব কিছুই হবে না। এটা তাদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত।
তিন.
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে তর্ক আছে। তবে এটা ঠিক, যিনি রাজনীতি করেন, মন্ত্রিত্ব করেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন, তিনি যদি প্রকৃতই ধর্মে বিশ্বাসী হন (যে ধর্মেরই হোক), তবে তার কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণের প্রভাব ও প্রতিফলন থাকবেই। এক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রয়োজন পড়ে না। বরং তার ধর্ম বিশ্বাসই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে পরিচালিত করে। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়াতে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিকসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইসলামের চেতনাবোধ রয়েছে। হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুসলমানদের অন্তরাত্মায় ইসলামী মূল্যবোধের চেতনা প্রোথিত হয়ে আছে। এটাই বাংলাদেশের মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। পরাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র কি ধর্মকে উপেক্ষা করতে পেরেছে? পারেনি। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই তারা ধর্মের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উঁচিয়ে শপথ করেন, ‘সো হেল্প মি গড’। তারা যেকোন সভা-সমাবেশ এই বলে শেষ করেন, ‘গড ব্লেস আমেরিকা’। এমনকি তাদের যে ডলার, সেখানেও তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা এবং ব্যবহার রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ধর্মের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা তা মেনে চলে। এ নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে কোন হইচই হতে দেখা যায় না। সেখানে যারা ধর্ম বিদ্বেষী বা ধর্মের নাম শুনলেই রেগে যান, তারাও ধর্মের কথা লেখা ডলারই ব্যবহার করছেন। অথচ আমাদের দেশের কিছু লোক, যারা নিজেদের অতি প্রগতিবাদী মনে করে, ধর্মের কথা শুনলেই তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মৌলবাদী বা জঙ্গী বলে আখ্যায়িত করে। তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলার মধ্যে যে ব্যক্তিস্বার্থ ও মতলববাজি রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফায়দা লুটতে চায়। পার্শ্ববর্তী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা হলেও, সেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে জীবনচর্চা হয় না, রাজনীতিও হয় না। বিশ্বে তারা বিভিন্নভাবে তাদের ধর্মকে তুলে ধরছে। মুম্বাইয়ের সিনেমাগুলোর ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আধুনিকতার মাঝেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে। ঘরে আলাদা করে পুজোর জন্য দেব-দেবীর মূর্তি রেখে দিচ্ছে। মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করছে। এমনকি বাংলাদেশে জনপ্রিয় কলকাতার বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালগুলোতেও তাদের ধর্মচর্চা ব্যাপক হারে দেখানো হচ্ছে। হলিউডের সিনেমায়ও গির্জায় গিয়ে এবং খাওয়ার আগে প্রার্থনার দৃশ্য অহরহ দেখানো হচ্ছে। মোদির শাসনামলে তো ভারতকে হিন্দু রাজ্যে পরিণত করার জন্য উগ্র হিন্দুরা উঠেপড়ে লেগেছে। তারা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিশন নিয়ে নেমেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও আইন করে মুসলমানদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও আমাদের দেশে অন্য ধর্মবলম্বীরা পারস্পরিক সহবস্থানের মাধ্যমে শান্তিতে বসবাস করছে। পুলিশসহ প্রশাসনের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে হিন্দুরা নেই। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়েও একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক ইসলামী রাষ্ট্রের নিদর্শন রাখতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ধর্ম নিয়ে কখনোই উগ্রতা প্রদর্শন বা বাড়াবাড়ি করা হয় না, হওয়ার আশঙ্কাও নেই। কিছু লোক যারা, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে ধর্মহীনতা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তারা প্রকারন্তরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছে। তাদের এ উপেক্ষা করা বোকার স্বর্গে বসবাস ছাড়া কিছুই নয়। ইসলামের রীতি-নীতি, মূল্যবোধ এবং সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনযাপন ব্রিটেনে কিভাবে প্রভাব ফেলেছে তার নজির পাওয়া যায় কয়েক বছর আগে। ব্রিটিশ সরকারের আংশিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত বাণিজ্যিক চ্যানেল ‘ফোর’ পবিত্র রমজান উপলক্ষে রমজানের প্রতিদিন তিন মিনিট ফজরের আজান প্রচার করত। ফজরের আজান প্রচার করা ছাড়াও অপর চার ওয়াক্ত নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্র প্রচার করত। পাশাপাশি তাদের ওয়েব সাইটেও তা সম্প্রচার করত। ইউরোপের কোন মূলধারার টিভি চ্যানেলে আজান প্রচারের নজির সেটিই প্রথম ছিল। এই আজান প্রচার করা নিয়ে সে সময় চ্যানেল ফোর-এর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান র্যালফ লি বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যে যে কয়টি ধর্মের প্রসার ঘটছে, তার মধ্যে ইসলাম অন্যতম। তিনি বলেন, যারা ইসলামকে সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করে, তাদের ভুল ভাঙ্গানোর জন্যই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বেও ইসলামের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে এখন স্বীকার করা হচ্ছে। ইসলাম যে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ অটুট রাখার বর্ম এবং শান্তির ধর্ম, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে।
চার.
বাংলাদেশে যে ধর্মীয় কোন উন্মাদনা নেই, তা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যে বহুবার বলেছে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফরে এসেও এ ধরনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ বিশ্বে সহনশীল ও সব ধর্মের মানুষের বসবাসের আদর্শ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সামনে বিশ্বে একটি আদর্শ এবং আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের রোল মডেল হয়ে আছে। এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য ইসলামী মূল্যবোধ, আচারÑআচরণ এবং রীতি-নীতি চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে চিরকালের মতো পারস্পরিক সহবস্থান ও সম্প্রীতির মাধ্যমে স্ব স্ব ধর্ম পালন করতে পারে, সে পরিবেশও বজায় রাখতে হবে। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মহীনতার কথা বলছে বর্জন করতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন