বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অসাধারণ সুন্দরবনে কয়েকদিন

ইছমত হানিফা চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:১০ এএম

এবারের গন্তব্য সুন্দরবন। হঠাৎ করেই আমন্ত্রণ পেলাম। এই ভ্রমণের কর্ণধার ডা. শাহজামান চেীধুরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ, চল্লিশজনের এই টিমে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। মার্চের ১৩ তারিখ সকালে সিলেট থেকে আমরা যারা যাব, সবাই একসাথে রওয়ানা দিলাম হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সিলেট থেকে যোগ হওয়াদের মধ্যে ছিলেন জামিল মামা মানে ডা. জামিল আহমদ চেীধুরী, জাফর স্যার, কিম ভাই আব্দুল করিম, বন্ধু জাকারিয়া আর আমি এবং সুমাইয়া। আমাদের মতো হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার থেকে এই ভ্রমণের সঙ্গীরা নিজ গাড়ি নিয়ে এসে একত্রিত হলাম হোটেল আল আমিন-এ। ঢাকা থেকে যোগ দিলেন সুজয় মৌরিসহ অন্যরা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে সিলেট থেকে ফ্লাইটে এসে যুক্ত হলেন উজ্জ্বল। পথে আর স্টপেজ নেই। গাড়িতে আমরা মোট চৌত্রিশ জনের বহরে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে যুক্ত হলেন আনসার উদ্দিন খান পাঠান। শুরু হলো স্বপ্নের সুন্দরবন যাত্রা।

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন। পানি, জঙ্গল, বাঘ এই নিয়ে সুন্দরবন। বিশে^র সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। যেখানে মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণী। পানিতে নানান জাতের মাছ যেমন আছে, তেমনি আছে কচ্ছপ, গিরগিটি, অজগর, গুইসাপ আর কুমির। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। ছোটবেলা থেকেই সুন্দরবন নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল আমার মনে। নিজের দেশে এমন জায়গায় ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। অবশেষে সুযোগ পেয়ে গেলাম। ঘুরে দেখা হলো হাড়বাড়িয়া, কটকা, জামতলা, কোকিলমনি, শরণখোলা, সুন্দরখাল আর ত্রিশঠা নদীর সাথে দেখা না হলেও তাদের স্রোতের দেখা মিলেছে বার বার। দেখেছি পানিতে অগনিত জেলি ফিশ। দেখেছি নানা ধরনের গাছ, কত রংয়ের ফুল, অবাক করা পাখি।

যাত্রাপথে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে গাড়ি থামল। তখন সময় ঠিক রাত ১২টা। ফেরিতে উঠে দেখলাম, বিশাল পদ্মায় আকাশের চাঁদ দোল খাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ফেরির ডেকে দাঁড়িয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটালাম। ফেরি পার হয়ে রাতের খাবার সেরে আবার গাড়িতে উঠলাম। রাত তখন ৩টা মংলায় গিয়ে গাড়ি থামলো। পশুর নদীতে নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন তোফাজ্জেল হোসেন ভাই। সবাই নৌকায় উঠলাম। আধঘণ্টা নৌকা চড়ে গিয়ে উঠলাম লঞ্চে। লঞ্চের পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি পরিবেশ প্রথম দেখায় দারুণ পছন্দ হয়ে গেল। আর কয়েক ঘণ্টা পর ভোরের আলো আসছে সেই খবরে পশুর নদীর বাতাসে কেমন মিষ্টি ঘ্রান। কানে এলো লঞ্চের ডেকে সুরের সাথে ভোরের গল্প চলছে। একদম নিচতলায় আমার রুম। রুম থেকে বেরিয়ে তৃতীয় তলায় মানে ডেকে এসে দেখি রিমনের নের্তৃত্বে অসম্ভব সুন্দরের সান্নিধ্যে সবাই জাতীয় সংগীত গাইছে। আকাশের লাল সূর্য সবুজ অরণ্যের কপালে টিপ হয়ে তাকিয়ে আছে। আর একের পর এক চলছে গান। গানে যেন মিশে আছে অব্যক্ত বাতাসের কলতান।
যাত্রার দ্বিতীয়দিন সকালে আমাদের গন্তব্য শরণখোলা দ্বীপ। নৌকা থেকে নেমে পেলাম বানরের দলের স্বাগত অভিবাদন। কিন্তু এই সাক্ষাতে প্রথম একটা বানর আমাদের এক সঙ্গীকে আক্রমণ করে বসেন, যা পরে কিছুটা আনন্দের খোরাক হয়ে যায়। পরের জন্য নিজের নিঃস্বার্থপরতার পরিচয় আগেও ছিল, যখন যাত্রা শুরু করি, বাসে সবার ছবি সুন্দর করে ক্যামেরা বন্দি করতে গিয়ে ক্যামেরাম্যান আছাড় খেয়ে পড়ে যান। আবার লঞ্চে উঠে জানতে পারলাম, খুলনায় আমাদের জন্য মাছ কিনতে গিয়ে আরেকজন বন্ধু আছাড় খেয়ে পড়ে যান। আবার আমরা যে নৌকা করে লঞ্চ থেকে নেমে দ্বীপগুলোতে যাই, সেই নৌকার উপরের ডেকে সবার বসার ব্যবস্থা, নিচে ইঞ্জিনসহ আরো কিছু রাখার জায়গা। সেই নিচের রুমে ঢাকনা খোলা ছিল। আরেক সাথী অসাবধানতাবশত পড়ে যান। সৌভাগ্য যে, এসব আছাড়ে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থা ছিল না।

শরণখোলা ফরেস্ট বিভাগের তত্ত্বাবধানে ওয়াকওয়ে আছে। কারণ, এই বনে গাছের শ^াসমূল এত বেশি যে, ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতেও ভয় লাগে। এই দ্বীপে দুইটা বড় বড় মিঠাপানির দীঘি রয়েছে। যেহেতু চারপাশে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সব প্রাণীর তৃষ্ণা মিটানোর এই সু-ব্যবস্থা। প্রাণীদের অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে আমাদের সাথে পা দিয়ে চলছে হরিণ, বানর, বন্য শূকর। মাঝেমাঝে আমাদের উঁকি দিয়ে দেখছে বনমোরগের দল। আকাশজোড়া হাজারো পাখি।

পুকুরে সবাই সাঁতার দিতে ব্যস্ত, আমরা কয়েকজন হেঁটে হেঁটে দেখলাম, সমুদ্রসৈকত জুড়ে কালের সাক্ষী হয়ে আজো উপড় হয়ে পড়ে আছে আইলা, সিডরের চিহ্ন। চোখ আটকে গেল এমনি একটা মরা গাছে। মৃত্যুকে আশ্রয় করে জন্ম নিচ্ছে নতুন গাছ। ফুল ফুটিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। শেষ যেখানে, শুরু সেখানেই। এই সুন্দর ফুলও তাই প্রমাণ করে। সমুদ্র বড়ই অশান্ত। তটিনীর তরঙ্গ অস্থিরতার গান শোনাচ্ছে।

মন যখন সুন্দরের উপমা সাজায়, তার চারপাশ সবই মনে হয় গোপালের রসগোল্লার মতো মৌ মৌ মিষ্টি। সকালের নাস্তা সেরে আমাদের গন্তব্য হাড়বাড়িয়া। গাইড সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন বনে চলার নিয়ম। বাঘ মামার দেখা পেলেও পেয়ে যেতে পারি। কারণ, এই যায়গায় আগেরদিন একসাথে পাঁচটি বাঘকে দেখা গেছে, যা ক্যামেরাবন্দি হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে নেট দুনিয়ায়। সারাদিন ঘুরে দেখা পেলাম হরিণ, শূকর, বন মোরগের। গাইড দেখালেন কয়েকটা গাছে স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে বাঘের আঙ্গুলের। কাদা লাগা নখ পরিষ্কার করতে বাঘ বেছে নেয় এই গাছগুলো। যাহোক, বাঘের এই নখের দাগ দেখতে গিয়ে দেখা গেল পায়ের ছাপ। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে সবাই অপেক্ষা করলাম মামার। এর ভিতরে গাইড এবং আমাদের সাথে থাকা গানম্যান মামার যে বর্ণনা দিলেন, তাতে কলিজা নিজের শরীরের ভিতরে আছে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই নিজ দায়িত্বে যতটুকু নিরব থাকা যায় ততোটুকু নিরবতা সঙ্গী করে লঞ্চে ফিরে এলাম। ভর দুপুরে ঠান্ডা বেলের শরবতের ছোঁয়ায় কলিজায় পানি এল। জোয়ার-ভাটার হিসাব করে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে চমৎকার দুপুরের খাবার শেষে আবার নৌকা নিয়ে সবাই মিলে গেলাম সুন্দরী খালে। এতো সুন্দর সুন্দরী গাছ আর সুন্দরী গাছের ফুল দেখে মনে হলো, সুন্দরবন নাম সার্থক। সুন্দরী গাছের ফল খাওয়া যায়, তা আমার জানা ছিল না। এই প্রথম জানলাম, এই গাছের ফল খাওয়া যায়। সুন্দরী ফলের ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে খিদা। রসনার চিন্তা নিয়ে রাতের ডিনারের আগে রিমন, সুজনের গান যেন পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে দিল। রিমনের দরাজ গলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো, পিন পতন নিরবতায় আমাদের মোহিত করে রেখেছিল। সেই সাথে বাধ্যযন্ত্রে মিঠুন আর জহিরের তুলনা হয় না। এমন সুরের স্বর্ণালি সন্ধ্যা বহুদিন পর উপভোগ করলাম। রাতের ডিনারে ছিল ফিশ এবং চিকেন বারবিকিউ। সুর আর রসনার ঢেকুর তুলে ঘুমাতে গেলাম। সকাল হওয়ার আগে উঠতে হবে। কাল ভোরে যাব কটকা।

ঘুম ভাঙ্গে পাখির ডাকে আর কেবিনের জানালা দিয়ে চোখ গেলে দেখা যায়, একদল হরিণ। দেখলে মায়া লাগে। যাহোক, এমনি এক বাসন্তি সময়ের কোলে চড়ে আমরা কয়েকজন চললাম কটকায়। জঙ্গলের জামতলা হয়ে বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর ভাবছি, মামার দেখা পেলেও পেয়ে যেতে পারি।

কটকা সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের দক্ষিণে খুলনা জেলায় অবস্থিত একটি পর্যটনস্পট। সৈকতটি সুন্দরবনের একটি অংশ। কটকা সমুদ্রসৈকত থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্য ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখার সুযোগ এই সৈকতে রয়েছে। এছাড়া চিত্রা হরিণের দল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বানর, বন্য শূকর এবং বিভিন্ন প্রকারের বন্য প্রাণীর সাথে শীতকালে কুমিরও দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই সমুদ্রসৈকত উপযুক্ত জায়গা।

জামতলা বা কটকা সৈকত হলো, বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবনের অন্যতম আর্কষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্য। কিন্তু এখন বনে বাঘের দেখা পাওয়া ভার। তবে বাঘের ছাপ দেখার জন্য টাইগার টিলায় যেতে হয়। কটকায় আমি যতটা হাসি মুখ নিয়ে হেঁটেছি, তারচেয়ে বেশি ভয় নিয়ে ভয় ঢাকার চেষ্টা করেছি। কটকায় বাঘের দেখা মিললো না। দুপুরের খাবার পর আমাদের টিম ছুটলো কোকিলমনির দিকে। সেখানে বন বিভাগের একটি বড় দীঘি আছে, যার পানি পান করছে বন্য শূকর আর চিত্রা হরিণ। সেই পুকুরে পা ভিজাতে গিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। দল বেঁধে ছোট বড় মাছ আমাদের পায়ে চুমো খাচ্ছিল। এর পরের ভোরে যাত্রা করমজল। যথারীতি সকালের রোদের হাসি দেখতে দেখতে আমরা করমজল এসে পৌঁছালাম। করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে আছে একমাত্র কুমির প্রজনন কেন্দ্র। কেন জানি, এই ভ্রমণে সব জায়গায় শতভাগ আনন্দ পেলেও, একমাত্র করমজলে কিছু ঘাটতি ছিল।

ভ্রমণের সঙ্গী যদি হয় সুন্দর মনের মানুষ তবে ভ্রমণ সার্থক। পাঁচদিনের এই সফর সঙ্গীদের মধ্যে কে সিনিয়র, কে জুনিয়র, তা ভাবা গেল না। কারণ, সবাই ছিলাম প্রিয় বন্ধু। অসম্ভব সুন্দর সময় লেখা হলো জীবন ডায়রিতে। পাখি প্রেমিক পাঠান ভাই সারাক্ষণ পাখি খুঁজতে ব্যস্ত। নিবাস চন্দ্র মাঝি ভ্রমণ বিষয়ে এতো এতো গল্প বললেন যে, সেই সব গল্পের রেশ ধরে ফিরতি পথে দেখা হলো বাগেরহাটের ষাট গম্ভুজ মসজিদ। পোশাকী পেশার আড়ালে এতো সুন্দর মানুষদের সংস্পর্শ মুগ্ধ করেছে। সুন্দরবনের জন্য এতগুলো ভালো মনের সাথে পরিচয় সুন্দরবনকে ধন্যবাদ। প্রকৃতির এই পরম আশ্রয়ে এই কয়েকটি দিন আর সুন্দর সাউন্ড সিস্টেমে মায়াবি বাদ্যযন্ত্রের ছোঁয়ায় রিমনের সাবলিল গলায় মুগ্ধ করা সুরের সন্ধ্যা, এক কথায় চমৎকার সময় আমার পরবর্তী জীবনে বাঁচার রসদ জোগাবে।
লেখক: নিবন্ধকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন