ম্যালেরিয়া মশাবাহিত দীর্ঘস্থায়ী রোগ। এতে কাঁপুনিসহ জ্বর আসে, ক্রমে রক্তহীনতা এবং প্রায়শ মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয় বা মৃত্যু ঘটে। ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ নানা রকমের এবং এ রোগ লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস ও বিপাকীয় বিপর্যয় থেকে উদ্ভূত। রোগটির বৈশিষ্ট্য জ্বর, গৌণ রক্তহীনতা, প্লীহাবৃদ্ধি এবং তীব্র পর্যায় থেকে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার উত্তরণ। রোগের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব অনেকগুলো উপাদানের উপর নির্ভরশীল যেমন: পরজীবীর প্রজাতি ও প্রকারভেদ, রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিবেশ ইত্যাদি।
ম্যলেরিয়া শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন টর্টি ১৭৫১ সালে। ইতালিয় শব্দ গধষ অর্থ- দূষিত ও ধৎরধ অর্থ- বায়ু হতে গধষধৎরধ (ম্যালেরিয়া) শব্দটি এসেছে। তখন মানুষ মনে করতো দূষিত বায়ু সেবনে এ রোগ হয়। অথচ, এটি একটি সংক্রমিত অ্যানোফেলিস স্ত্রী মশার কামড়ের মাধ্যমে শুরু হয়, যা তার লালার মাধ্যমে সংবহন তন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শেষে যকৃতে পৌঁছায়, যেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশবৃদ্ধি করে।
সচেতনতামূলক দিবস হিসেবে প্রতিবছর এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস সমগ্র বিশ্বে পালন করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত¡াবধানে এই দিবস সমগ্র বিশ্বের এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ এবং এর সঙ্গে জড়িত অন্য সংস্থাগুলো ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ এবং সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই দিবস পালন করে। ২০১২ সালে ম্যালেরিয়াতে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যার বহুসংখ্যক ছিল আফ্রিকার শিশু। এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্য প্রাচ্য এবং ইউরোপের কিছু অংশও ম্যালেরিয়ার কবলে পড়েছে।
বিশ্ব ম্যালেরিয়া রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের মৃত্যু এবং ২১২ মিলিয়ন নতুন করে ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হার ২১ ভাগ এবং মৃত্যুর হার ২৯ ভাগ কমেছে। সাব-সাহারান আফ্রিকাতে সেই হার ক্রমে ২১ এবং ৩১ ভাগ কমেছে। ম্যালেরিয়া সাধারণত দারিদ্রতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত। এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান বাধা হতে পারে।
ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের তুলনায় এতে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। ম্যালেরিয়াকে অনেকেই উষ্ণমÐলীয় বা উপ-উষ্ণমÐলীয় রোগ বলেন, কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। অতীতে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও উত্তর রাশিয়াতে ম্যালেরিয়ার মহামারি দেখা দিয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকেও আমেরিকা মহাদেশে বছরে ৬০-৭০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো।
দক্ষিণ চীন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও এশিয়া মাইনরে ম্যালেরিয়া ছিল একটি অপ্রধান আঞ্চলিক রোগ। কোনো কোনো দ্বীপে যেমন, মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, গুয়াম, হাওয়াই, মিডওয়ে দ্বীপপুঞ্জ ও নিউজিল্যান্ডে ম্যালেরিয়া নেই। রোগটির সর্বাধিক প্রাদুর্ভাব স্বল্প আর্দ্র অঞ্চলে ও সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় এবং সর্বনিম্ন মরু ও পার্বত্য অঞ্চলে। এর বিস্তার বাহক মশার উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল।
বিগত ৭৫ বছরে রোগটি পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই হ্রাস পেয়েছে। এককালের ম্যালেরিয়া প্রবণ ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকাই এখন এই রোগমুক্ত এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও তা নির্মূলপ্রায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সা¤প্রতিক হিসাব অনুযায়ী শতাধিক দেশ এবং পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবছর মশাবাহিত এ রোগে ৩০-৫০ কোটি লোক আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১৫-২৭ লক্ষ। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে একদা নিশ্চিহ্নপ্রায় ম্যালেরিয়া পুনরুত্থানের সম্পর্ক খুঁজে পান।
উষ্ণমÐলীয় রোগ ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রপথিক, স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৪ সালে মশা যে ম্যালেরিয়া বাহক সে অনুমান ব্যক্ত করেন। তাঁরই অব্যাহত নির্দেশনা ও উৎসাহের কারণে ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭-৯৮ সালে ভারতে সেই বিস্ময়কর আবিষ্কার, মশাই নিশ্চিতরূপে ম্যালেরিয়া জীবাণু বাহক, সম্পন্ন করেন এবং দুবার নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। রোনাল্ড রস মানুষের ম্যালেরিয়া এবং বাহক হিসেবে অ্যানোফেলিস মশার ভূমিকা আবিষ্কার করলেও তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হলো কিউলেক্স মশার মধ্যে পাখিদের ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর সম্পূর্ণ জীবনচক্র আবিষ্কার।
তিনি পাখি থেকে মশাতে এবং মশা থেকে পাখিতে এই চক্রটির পুনরার্বতন আবিষ্কার করেন। ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে ইতালীর গবেষক জি.বি গ্রাসি এবং জি. বাস্তিয়ানেলি সর্বপ্রথম মশা দ্বারা মানুষকে সংক্রমিত করান, মানুষের শরীরে পরজীবীর গোটা পরিস্ফুরণ বর্ণনা করেন এবং ম্যালেরিয়া যে শুধু অ্যানোফেলিস মশাই ছড়িয়ে থাকে সেটাও অনুমান করেন, যা এখনও সঠিক বলে গণ্য। পরবর্তীকালে বহু বৈজ্ঞানিক ও গবেষক সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে অহড়ঢ়যবষবং-এর কয়েকটি প্রজাতিই ম্যালেরিয়ার জীবাণু বাহক এবং চষধংসড়ফরঁস-এর তিনটি প্রজাতির জীবাণু ম্যালেরিয়ার কারণ।
ম্যালেরিয়ার পরজীবী চষধংসড়ফরঁস গণভুক্ত এককোষী প্রাণী, যার চারটি প্রজাতি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়: চষধংসড়ফরঁস ারাধী, চ. ড়াধষব, চ. সধষধৎরধব, এবং চ. ভধষপরঢ়ধৎঁস। বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য ম্যালেরিয়া পরজীবীদের দুটি পোষকের প্রয়োজন, মানুষ ও স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা। মশাকে বাহক বলা হয়ে থাকে, কারণ মশাই একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষে রোগটি ছড়ায়। সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার দংশনেই পরজীবীরা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
দংশনের আধঘণ্টার মধ্যেই পরজীবী রক্তপ্রবাহের সঙ্গে যকৃতে পৌঁছায় এবং সেখানে বংশবৃদ্ধি শুরু করে। জীবাণুর জীবনচক্রের এই অংশকে ‘লোহিতকণিকা বহিস্থ চক্র’ বা বীড়বৎুঃযৎড়পুঃরপ পুপষব বলা হয়। কয়েকদিন পর জীবাণু যকৃত ত্যাগ করে রক্তের লোহিতকণিকা আক্রমণ করে এবং সেখানে আরেক দফা বংশবৃদ্ধির ‘লোহিতকণিকা চক্র’ (বৎুঃযৎড়পুঃরপ পুপষব) শুরু করে। লোহিত কণিকা শীঘ্রই জীবাণুতে ভরাট হয়ে ফেটে যায় এবং রক্তে পরজীবী অবমুক্ত করে। একই সঙ্গে কিছু বিষাক্ত দ্রব্যও বিমুক্ত হয়। রোগীর তখন কাঁপুনি ওঠে এবং প্রবল জ্বর অনুভব করে।
অনেক ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া রোগীদের কাঁপুনিজ্বর বা পালাজ্বর শুরুর আগে কয়েকদিন একটানা জ্বর চলতে পারে। চ. ারাধী ও চ. ড়াধষব ম্যালেরিয়াতে একদিন পর পর জ্বর আসে। চ. সধষধৎরধব সংক্রমণে প্রতি তৃতীয় দিনে জ্বর হয়। কিন্তু চ. ভধষপরঢ়ধৎঁস জীবাণুতে জ্বরের কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট ধরন থাকে না। সংক্রমিত লোহিত কণিকা মস্তিষ্ক, বৃক্ক, যকৃত, ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্র রক্তনালির গায়ে লেগে থাকে। রোগী ক্ষীণ চেতনা ও খিঁচুনির দরুন অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এটাই মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়া। শেষ পর্যন্ত রোগী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়।
বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রায় ৩৪ প্রজাতির অ্যানোফেলিস মশার মধ্যে সাতটি ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায় বলে জানা গেছে। এই সাতটির মধ্যে চারটি অহড়ঢ়যবষরং ফরৎঁং, অ. ঢ়যরষরঢ়ঢ়রহবহংরং, অ. ংঁহফধরপঁং, এবং অ. সরহরসঁং গুরুত্বপূর্ণ ম্যালেরিয়া বাহক। অবশিষ্ট তিনটি অ. ধপড়হরঃঁং, অ. ধহহঁষধৎরং, এবং অ. াধমঁং ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এলাকায় থাকার দরুন ম্যালেরিয়ার বাহক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অ. ফরৎঁং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী বনাকীর্ণ এলাকা ও পাহাড়তলীতে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এই বুনো প্রজাতিটি মূলত ঘরের বাইরে থাকে এবং প্রধানত মাঝরাতে দংশন করে। দিনের বেলা এদের বসত ঘরে পাওয়া যায় না। রক্ত শোষণের আগে এরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় এবং রক্ত খাওয়ার পরপরই বাইরে পালায়। এগুলো ঘরের বাইরেও দংশন করে থাকে।
বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া সর্বদাই একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। রোগটি এখনও দেশের উত্তর ও পূর্বাংশে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তলগ্ন স্থানগুলোর একটি আঞ্চলিক রোগ। দেখা গেছে, যেসব লোক ম্যালেরিয়ামুক্ত অঞ্চল থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে, তাদের মধ্যে ম্যালেরিয়া আক্রমণ ও মৃত্যু বেশি। এমনকি ঢাকা শহরেও প্রায়ই ম্যালেরিয়ার খবর পাওয়া যায়। আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগের ঘটনাগুলি অজানাই থেকে যায় এবং অনেক রোগীই সংগঠিত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ গ্রহণ করে না।
বর্তমানে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদের কর্মকৌশল হলো দ্রæত ম্যালেরিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা প্রদান। ম্যালেরিয়া সাধারণত বøাড ফিল্মস ব্যবহার করে রক্তের দূরবীক্ষণ পরীক্ষা অথবা অ্যান্টিজেন-ভিত্তিক দ্রæত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে প্যারাসাইটের ডিএনএ শনাক্ত করার জন্য পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়ার ব্যবহার উন্নত করা হয়েছে, কিন্তু এর খরচ ও জটিলতার জন্য ব্যাপকভাবে ম্যালেরিয়া-কবলিত এলাকায় ব্যবহার করা হয় না।
মশারি বা কীটনাশকে মেশানো মশারি কিংবা অন্যান্য মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করে মশার কামড় প্রতিরোধ করার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ হ্রাস করা সম্ভব। মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উপায় হল কীটনাষক প্রয়োগ এবং জমা পানি বের করা দেওয়া, যেখানে সাধারণত মশা ডিম পাড়ে। জমা পানিতে মশা ডিম পারলে, সেখানে কীটনাষক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দিতে হবে। কুইনাইন অথবা আর্টিমেসিনিন গ্রæপের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ দিয়েও এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন